সিডিপির ৮ প্রশ্ন, দেশের চ্যালেঞ্জ ৩টি

২০২৪ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে আসার কথা ছিল।

বেসরকারি খাতকে সুবিধা দিতে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে বাড়তি দুই বছর সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা এমন বক্তব্যই তুলে ধরেন। সভায় অংশ নেওয়া সরকারের একাধিক সচিব বলেন, বাংলাদেশ যাদের সঙ্গে ব্যবসা করে, সেসব দেশের অবস্থা ততটা ভালো নয়। ফলে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে গেলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকবে না। তাই এলডিসি থেকে বের হতে দুই বছর বেশি সময় চাওয়া হয়।

এদিকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর অর্থায়নের বিকল্প উৎস কী হবে, তা জানতে চেয়েছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। তারা বলছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে গেলে সহজ শর্তে ঋণসুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধাও। তখন অর্থায়নের বিকল্প উৎস কী হবে? এর আগে মঙ্গলবার অনলাইনে সিডিপির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বৈঠকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সময় দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

সভায় সিডিপির প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। তাই অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের হার বাড়াতে কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের, তা জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে কী ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা-ও জানতে চায় সিডিপি। এ রকম আটটি বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে জানতে চান সিডিপির সভাপতি হোসে আন্তনিও ওকাম্পোসহ অন্য প্রতিনিধিরা।

সভায় উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা অব্যাহত রাখতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানতে চায় সিডিপি। সভায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে লিখিত আকারেও এসব প্রশ্নের জবাব সিডিপিকে দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাবেক সচিব মনোয়ার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিডিপি আমাদের কাছে বেশ কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে। তারা বলেছে, তোমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে সব ধরনের বাণিজ্যসুবিধা হারাবে। তখন আয়ের বিকল্প উৎস কী হবে। তোমাদের রাজস্ব আদায়ের হারও কম। আমরা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা তাদের প্রশ্নের লিখিত জবাব দেব।’

এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বাণিজ্যে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে গেলে শীর্ষ বাজারগুলোতে পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশই বর্তমানে বাণিজ্যসুবিধার আওতায় শীর্ষ ১২টি বাজারে হচ্ছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে বের হলে বাজারসুবিধা হারিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে রপ্তানিকারকদের। তাতে বাড়তি শুল্কের চাপে পড়ে রপ্তানি আয় ৫৩৭ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা কমতে পারে, যা দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ।

এদিকে করোনা–পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে উঠে আসা তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা সিডিপির সভায় তুলে ধরেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, কোভিড–১৯ বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনায় আমদানি-রপ্তানি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বিরাট সমস্যা। তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে বাণিজ্যসুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। তাই এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং সহজ শর্তে বিকল্প ঋণের ব্যবস্থা করার দাবিও জানান। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবও করেন তিনি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের সামনে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ। কবে নাগাদ বিশ্ব থেকে করোনা বিদায় নেয়, কেউ জানি না। তাই আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করেছি এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় পিছিয়ে দিতে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে সরকার এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটিকে সাধুবাদ জানাই।’