সীমান্তে অপেক্ষায় পেঁয়াজবাহী ৮০৩ ট্রাক, পচনের আশঙ্কা

পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরা বাজারে তার প্রভাব এখনো কম। বর্তমান মূল্যতালিকা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পেঁয়াজের বাজারে। গতকাল বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে
ছবি: হাসান রাজা

পেঁয়াজ রপ্তানিতে হুট করে ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে বড় বিপদে পড়েছেন খুলনার আমদানিকারক আবদুল হামিদ। তাঁর আমদানি করা ৭১ টন পেঁয়াজ যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে আটকে আছে। ট্রাকে করে এসব পেঁয়াজ গত মঙ্গলবার সীমান্ত পার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগের দিন সন্ধ্যায় ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে আবদুল হামিদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আর এক-দুই দিনের মধ্যে ওই পেঁয়াজ ছাড় করতে না পারলে বেশির ভাগ পচে যাবে। ত্রিপল দিয়ে ট্রাকে ঢেকে রাখা পেঁয়াজ বড়জোর তিন-চার দিন ঠিক রাখা যায়। গরম তীব্র হলে ট্রাকে থাকা পেঁয়াজ দ্রুত পচে যায়। আবার বৃষ্টি হলেও নষ্ট হয়।

ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, যশোরের বেনাপোল, দিনাজপুরের হিলি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজবাহী অন্তত ৮০৩টি ট্রাক দেশে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে বেনাপোলে ৩টি, হিলিতে অন্তত ২০০টি, ভোমরায় অন্তত ৩০০টি এবং সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজবাহী ৩০০ ট্রাক ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে।

এদিকে ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো গত রাতে প্রথম আলোকে বলছে, বাংলাদেশের অনুরোধের কারণে ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ পাঠানোর (রপ্তানি) সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তবে ওই সিদ্ধান্তের আলোকে সীমান্তে আটকে থাকা ট্রাকগুলো ছাড়া হবে, নাকি নতুন করে ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।

পুরান ঢাকার শ্যামবাজারকেন্দ্রিক আমদানিকারক আবদুল মাজেদ প্রথম আলোকে বলেন, এক একটি ট্রাকে প্রায় ২০ টন করে পেঁয়াজ থাকে। গত চার দিনেও ট্রাক ঢুকতে না পারায় নতুন পেঁয়াজ পচন শুরু হয়েছে। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ নতুন পেঁয়াজবাহী ট্রাক সরিয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অল্প দামে বিক্রি করে ফেলেছেন। এতে ক্ষতি কিছুটা কমবে। তিনি বলেন, পুরোনো পেঁয়াজ এখনো ঢোকার অপেক্ষায় আছে। এগুলোও কিছু পচে যাবে। এই ট্রাকগুলো তাড়াতাড়ি ছাড়া দরকার।

দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ১০ হাজার টন পেঁয়াজ ঢোকার কথা রয়েছে। তিন দিন ধরে বৃষ্টির মধ্যে পেঁয়াজের গাড়িগুলো ভারতীয় অংশে আটকা পড়ে আছে। এতে পেঁয়াজের পচনের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন উর রশিদ। একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান।

দাম কিছুটা কমেছে

রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজ আসা বন্ধ ঘোষণার পর দাম দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তবে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে পেঁয়াজের দাম খানিকটা কমতে শুরু করেছে। তবে বাজারে পেঁয়াজের ক্রেতা এখন খুবই কম বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, মানভেদে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫ থেকে ১৫ টাকা কমেছে। শনিবার (আজ) নাগাদ দাম আরও কমে আসবে বলে তাঁদের ধারণা। খুচরা বাজারে এক মাস আগে পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা কেজি। দুই সপ্তাহ আগে সেই দাম ওঠে ৬০ টাকায়। রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা আসার পর প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ওঠে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত।

গতকাল সকালে মালিবাগ বাজারে পেঁয়াজ কিনছিলেন চাকরিজীবী শামীমা আক্তার। বিক্রেতা দাম বলার পর চোখ কপালে তুললেন তিনি। দামে পোষায়নি বলে শেষে কিনলেন আধা কেজি পেঁয়াজ। তিনি বলেন, এক কেজি কেনার ইচ্ছা থাকলেও বাড়তি দামের কারণে আধা কেজি কিনেছেন।

মালিবাগ বাজার থেকেই গতকাল সকালে তিন কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন ব্যবসায়ী কাজী শফিক। প্রতি কেজি ৯০ টাকা করে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটা ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। মাঝখান দিয়ে ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের।

মালিবাগ বাজারে গতকাল প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা। এই বাজার থেকে ঠিক দুই কিলোমিটার দূরের খিলগাঁও রেলগেট বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ অবশ্য বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকায়।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানালেন, দাম বেড়ে যাওয়ার পর পেঁয়াজ বিক্রিও কমে গেছে। ক্রেতারা খুবই কম পেঁয়াজ কিনছেন। মালিবাগ রেলগেট বাজারের খোরশেদ স্টোরে এক মাস আগেও দিনে প্রায় ৭০ কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হতো। দাম বাড়তি হওয়ার পর এই দোকানে গত দুই সপ্তাহে বিক্রি নেমে আসে দিনে ১৫ থেকে ২০ কেজিতে।

খোরশেদ স্টোরের দোকানি মো. শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো জিনিসের দাম বেড়ে গেলে মানুষ এখন আর বস্তা ভরে কিনে মজুত করে না। খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি একেবারেই কমে গেছে।

এদিকে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির ঘটনায় অসাধু চক্রকে দুষছেন ঢাকা মহানগর দোকান মালিকেরা। তাঁরা বলছেন, দেশে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল ছিল। পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অথচ আড়তে, পাইকারি ও খুচরা বাজারে পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত আছে। পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে গতকাল বিকেলে কারওয়ান বাজারের একটি হোটেলে সভা করে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতি। এতে কারওয়ান বাজারের কাঁচামাল আড়ত বহুমুখী সমবায় সমিতি, আমদানিকারক ও খুচরা বিক্রেতারা অংশ নেন। ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল করতে মনিটরিং সেল গঠনের পরামর্শ দেন। তাঁরা বলছেন, শুধু ভারতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পেঁয়াজ আমদানি চীন, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও মিসর থেকে নিয়মিত করা হোক।

ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তৌফিক এহসান প্রথম আলোকে বলেন, পেঁয়াজ আমদানিতে শুধু ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। পাশাপাশি দেশি পেঁয়াজ যখন বাজারে আসে, তখন আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে কৃষক লাভবান হবেন, দেশি পেঁয়াজও বাজারে সহজলভ্য হবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জসাতক্ষীরা; যশোর অফিসপ্রতিনিধি, দিনাজপুর]