স্বাস্থ্যে কেন অস্বাভাবিক কেনাকাটা

স্বাস্থ্য খাতে কোনো ‘রেট শিডিউল’ না থাকায় বাজারমূল্যের চেয়ে বেশিতে এমনকি অস্বাভাবিক দামে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা হয়।

দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে যন্ত্রপাতি কেনাকাটার প্রস্তাবটা ছিল এ রকম—একেকটি গগলস ৫ হাজার টাকা, বালিশ ২৭ হাজার ৭২০ টাকা, হ্যান্ড গ্লাভস ৩৫ হাজার টাকা এবং রক্ত পরীক্ষায় ব্যবহৃত ক্ষুদ্রাকার টিউব ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমন অস্বাভাবিক প্রস্তাবে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর ওই সব যন্ত্রপাতির দাম সংশোধন করা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারও হচ্ছে।

কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি নির্ধারণ করে? এ নিয়ে খোঁজ করতে গোড়াতেই গলদ থাকার কথা জানা গেল। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, অন্যান্য দপ্তরে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় ‘রেট শিডিউল’-এর মাধ্যমে। যেমন এক টন রড বা সিমেন্ট কিংবা পাথরের দাম কত হবে, তা রেট শিডিউলে নির্ধারণ করা থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় এ ধরনের ‘স্ট্যান্ডার্ড ইউনিট ব্যয়’ নির্ধারণ করা নেই। ফলে উল্টাপাল্টা দাম ধরার সুযোগ পায় এই খাত।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, যন্ত্রপাতির একক দর নির্ধারিত না থাকার সুযোগেই বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম নির্ধারণ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ক্ষেত্রে তাদের ধরার সুযোগও থাকছে না।

জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের আলাদা রেট শিডিউল আছে। সে অনুযায়ী পণ্যের দাম ঠিক হয়। স্বাস্থ্য ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বেলায় এ পদ্ধতি নেই।

এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানির কেনাকাটা

স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের দাম যাচ্ছেতাইভাবে নির্ধারণের আরেকটি ঘটনা জানা গেছে এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডের একটি প্রকল্পের সূত্র ধরে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারী এই প্রতিষ্ঠান তাদের বর্তমান প্ল্যান্ট অর্থাৎ কারখানাটি রাজধানীর তেজগাঁও থেকে সরিয়ে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় নিতে চায়। এ জন্য ১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। নতুন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর ভবন নির্মাণ ও আসবাব কেনাকাটায় খরচ ধরা হয়েছে ৭৭৯ কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত প্রকল্পটির জন্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় যে খরচ দেখানো হয়েছে, সেটাকে অস্বাভাবিক বলছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় যেভাবে খরচ ধরা হয়েছে, তা বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিসের ভিত্তিতে যন্ত্রপাতির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, পরিকল্পনা কমিশনের এমন প্রশ্নের জবাবে এসেনশিয়াল ড্রাগ থেকে জানানো হয়েছে, গোপালগঞ্জে এসেনশিয়াল ড্রাগের একটি কারখানা নির্মিত হচ্ছে। সেই কারখানার জন্য কেনা যন্ত্রপাতির ক্রয়মূলের ওপর ভিত্তি করে নতুন প্রকল্পের যন্ত্রপাতির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নতুন যেসব যন্ত্রপাতি কেনা হবে, সেগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বর্তমান বাজার থেকে তথ্য নিয়ে।

পরিকল্পনা কমিশনের বক্তব্য হলো, এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানির নতুন এই প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগসহ যানবাহন, কম্পিউটার, আসবাব ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির বিপরীতে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, সেটির সঙ্গে বর্তমান বাজারমূল্যের মিল নেই। তাদের জন্য রেট শিডিউল বা স্ট্যান্ডার্ড ইউনিট ব্যয় নির্ধারণ করা নেই বলে তারা অস্বাভাবিক ব্যয় ধরার সুযোগ পেয়েছে।

এ সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) নাসিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাই, যন্ত্রপাতির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কীভাবে? তখন তারা আরেকটি প্রকল্পের উদাহরণ টেনে আনে। কিন্তু অন্য প্রকল্পকে উদাহরণ টেনে পণ্যের দাম নির্ধারণ হতে পারে না। আমাদের কাছে যখন মনে হয় যন্ত্রপাতির দাম বেশি, তখন একটা কমিটি করে দিই। কমিটি পরে পণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনে।’ স্বাস্থ্য খাতে একক দর নির্ধারণ করা না থাকায় এমন সমস্যা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এ প্রকল্পের আওতায় পরামর্শকের পেছনে ফি ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। ট্যাবলেট উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ১৫৫ কোটি টাকা। ক্যাপসুল ও ড্রাই সিরাপ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। ৩০টি ফটোকপিয়ার মেশিন কেনা বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রতিটি ফটোকপিয়ার কেনায় খরচ পড়বে ৫ লাখ টাকা করে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব খাতে যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অস্বাভাবিক। এ ছাড়া অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনাকাটায় বেশি মূল্য ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।

এসেনশিয়াল ড্রাগ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দাম কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করেছে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. এহসানুল কবির জগলুল প্রথম আলোকে বলেন, আগে নেওয়া প্রকল্পের মাধ্যমে কেনা যন্ত্রপাতির যে দাম পড়ে, পরের প্রকল্পে সে অনুপাতে দাম নির্ধারণ করা হয়। তা ছাড়া এসেনশিয়াল ড্রাগসের কেনাকাটাসংক্রান্ত একটি দল আছে, যারা বাজারে গিয়ে যন্ত্রপাতির বাজারমূল্য দেখে তারপর দাম নির্ধারণ করে। সে প্রস্তাব চলে যায় পরিকল্পনা কমিশনে। তারাই সবকিছু চূড়ান্ত করে।

তবে স্বাস্থ্যের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার জন্য অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করা উচিত বলে মনে করেন এহসানুল কবির জগলুল। তিনি বলেন, ওই কমিটি প্রতিবছর আন্তর্জাতিক বাজার দেখে যন্ত্রপাতির দাম ঠিক করে দেবে। দেশে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানি বা কেনাকাটায় একটা স্ট্যান্ডার্ড রেট থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আন্দাজের কেনাকাটা নিয়ে আলোচনা

এদিকে ‘আন্দাজের ওপর’ হাসপাতালের যন্ত্রপাতির দাম নির্ধারণের এই ধারা থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, তা নিয়ে গত ৩১ আগস্ট পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীসহ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা (সচিব) উপস্থিত ছিলেন। সেখানে অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পেরও পণ্যের একক দাম নির্ধারণ না থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পে আবশ্যিকভাবে নিরপেক্ষ তৃতীয় একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সমীক্ষা করতে হবে। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে এখন থেকে সমীক্ষা করা যাবে না বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, সমীক্ষা না করে প্রকল্প গ্রহণের কারণে বারবার তা সংশোধন করতে হয়। প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়াতে হয়। এতে সরকারি টাকার অপচয় হচ্ছে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সমীক্ষা করালে সত্যিকারের তথ্য উঠে আসে না। স্বার্থের সংশ্লেষ থাকে। তাই বেসরকারি, অর্থাৎ তৃতীয় কোনো স্বাধীন সংস্থাকে দিয়ে সমীক্ষা করতে হবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা রেট শিডিউল নেই, এটা যেমন ঠিক, তেমনি স্বাস্থ্যের বেলায় রেট শিডিউল ঠিক করে দেওয়াও ঠিক হবে না। কারণ, স্বাস্থ্যের বাজার ভিন্ন। দেশে রড, সিমেন্ট, বালু ও পাথরের বাজার থাকলেও মেডিকেলের বাজার নেই। তা ছাড়া স্বাস্থ্যের যন্ত্রপাতির দাম প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে।

শামসুল আলম মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি স্বাধীন ও বেসরকারি খাতের চিকিৎসকদের দিয়ে ‘মূল্য যাচাই কমিটি’ করে দেওয়া যেতে পারে। চিকিৎসক ছাড়া কারও পক্ষে দাম নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। তবে এর একটা সুরাহা হওয়া জরুরি।