২৭ দেশে সুবিধা হারানোর শঙ্কা

বাংলাদেশকে শুল্ক সুবিধা দেয় ইইউ। তা অব্যাহত রাখতে ইইউর চাওয়া অনুযায়ী তৃতীয়বারের মতো রূপরেখা পাঠিয়েছে সরকার

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালে চূড়ান্তভাবে বের হয়ে যাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ীই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে আর কোনো শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাবে না।

তবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঢুকে গেলে বাংলাদেশের সামনে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধার বিকল্প ‘জিএসপি প্লাস’ পাওয়ার সুযোগ থাকবে। এ জন্য বাংলাদেশকে অবশ্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। শ্রমমান উন্নয়নের পাশাপাশি প্রণয়ন করতে হবে শ্রম অধিকারবান্ধব আইন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন এবং কথা বলার স্বাধীনতাই–বা কতটুকু ভোগ করতে পারছে মানুষ, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

সেগুলো অবশ্য পরের বিষয়। এখন ইইউ থেকে বিদ্যমান শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া নিয়েই চিন্তা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। কারণ, বিদ্যমান সুবিধা বহাল রাখতে দেড় বছর আগে থেকে বাংলাদেশের শ্রমবান্ধব আইনের জাতীয় রূপরেখা চেয়ে আসছে ইউরোপের ২৭ দেশের জোট ইইউ। গত মাসে তৃতীয়বারের মতো ইইউতে সেই রূপরেখা পাঠিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এর আগে দুই দফায় রূপরেখা পাঠানো হলেও তা ‘অসম্পূর্ণ’ বলে ফেরত পাঠিয়েছে ইইউ। তৃতীয় নতুন রূপরেখাটিও অসম্পূর্ণ বলে জানা গেছে। মূলত শ্রম ও কর্মসংস্থান, বাণিজ্য এবং পররাষ্ট্র—এই তিন মন্ত্রণালয় মিলে রূপরেখাটি করেছে। এখন ওই রূপরেখার ওপর ইইউর মতামত পাওয়ার অপেক্ষা।

এদিকে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত এপ্রিলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীনকে পাঠানো এক চিঠিতে ইইউ থেকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। চিঠিতে তিনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও দর–কষাকষি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিঠি পেয়েছি এবং আমরা এ বিষয়ে সজাগ আছি। ইইউর সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, ইইউ থেকে শুল্ক সুবিধা পাব, জিএসপি প্লাসও পাব ভবিষ্যতে।’ বাণিজ্যসচিব পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার আশ্বাস দিয়ে ইতিমধ্যে পররাষ্ট্রসচিবের চিঠির জবাব দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

তরুণদের ব্যবসায় আকৃষ্ট করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ব্যবসায়িক নানা কাজ সহজ করতে হবে।
আবু বকর সিদ্দিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউরো অ্যাগ্রোভেট

জিএসপি প্লাস কী

২০১৪ সালে নিম্ন আয়ের দেশ এবং নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে শূন্য শুল্কে বাজার সুবিধা প্রদানের যে কর্মসূচি চালু করা হয়, সেটাই ‘জিএসপি প্লাস’ নামে পরিচিত। দক্ষিণ এশিয়া থেকে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান তা পাচ্ছে। এদিকে ইইউর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) থাকার সুবিধা ভোগ করছে ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

ইইউ সচিবালয় ২০১৮ সালে বলেছিল, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও মুক্ত চিন্তা প্রকাশের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস দেওয়ার ক্ষেত্রে ইইউ এই দুটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে পারে বলে বিশ্লেষক-গবেষকেরা মনে করেন।

রূপরেখা কেন গুরুত্বপূর্ণ

ঢাকায় ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের একটি অধিবেশন বসেছিল ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর। ওই অধিবেশনে বাংলাদেশ ইইউকে শ্রমবান্ধব রূপরেখা তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই রূপরেখা তৈরির জন্য ৯টি সুপারিশ করে ইইউ, যেগুলো ইইউর বাজারে বাংলাদেশি পোশাকপণ্যের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বহাল থাকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ইইউর ২৭ দেশেই রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৭১৫ ডলার বা ৬২ শতাংশ। এই হিসাব থেকেই বোঝা যায়, ইইউর চাহিদা অনুযায়ী রূপরেখা প্রণয়ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রমসচিব কে এম আবদুস সালাম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম জায়গা ইইউ। ফলে ইইউর চাওয়াকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তবে দেশীয় বাস্তবতা বলেও একটা কথা আছে। আইন সংশোধন বা রূপরেখা তৈরির সময় তা–ও মাথায় রাখতে হয়।’

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ যে আজ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, তার পেছনে অন্যতম অবদান ইইউর। ইইউ বাংলাদেশকে অস্ত্র ছাড়া সবকিছুতে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়ে আসছে।

অসম্পূর্ণ রূপরেখা ইইউর অপছন্দ

রূপরেখার একটি খসড়া ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ইইউতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এটি পছন্দ হয়নি তাদের। কারণ, শ্রমমান উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত মূল বিষয়গুলোই ওই খসড়ায় ছিল না। সর্বশেষ খসড়ায়ও শ্রম অধিকারের কিছু বিষয় নেই বলে জানা গেছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ছয় মাস আগে রূপরেখা প্রণয়নে আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। পরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টরের সঙ্গে বৈঠক হয় শ্রমসচিবের। এরপর গত ৩০ নভেম্বর ইইউতে দ্বিতীয় পাঠানো হয় খসড়া রূপরেখা। সেটিও পছন্দ হয়নি ইইউর। তারা খসড়ার ওপর গত ১০ ডিসেম্বর নিজেদের মতামত জানিয়ে বলেছে, এবারও পছন্দ হয়নি। এরপর নতুন করে সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঢাকার গুলশানের বাসায় এ বিষয়ে বৈঠক হয়। এরপর ৫ এপ্রিল তৃতীয় খসড়া পাঠানো হয়।

রূপরেখা অসম্পূর্ণ কেন, জানতে চাইলে শ্রমসচিব বলেন, ‘ঠিকই আছে। দেখি তাদের মতামত কী আসে।’

শিশুশ্রম দূর হোক

শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখতে ইইউর অন্যতম সুপারিশ হচ্ছে, শ্রম আইন, শ্রমবিধিমালা ও ইপিজেড আইনের সংশোধন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে এই সুপারিশ করেছে ইইউ।

২০০৬ সালে শ্রম আইন হওয়ার পর থেকেই সমালোচনা ছিল যে এটি শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই আইন সংশোধনের দাবি জোরালো হয়। পরে শ্রম আইন ও শ্রমবিধিমালা সংশোধিত হয়। তা দেখে ইইউ বলেছে, আইন ও বিধিমালার অনেক কিছুই শ্রমবান্ধব নয়।

বিদ্যমান আইনে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো কারখানায় নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ রকম নিয়োগ দিলে জরিমানা গুনতে হয়। তবে আইন অনুযায়ী, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের কারখানায় হালকা কাজে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ২০২১ সালের মধ্যে এবং সব ধরনের শিশুশ্রম ২০২৫ সালের মধ্যে নিরসনের কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছে ইইউ। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শিগগিরই এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প হাতে নেবে বলে জানা গেছে। যদিও রূপরেখায় এ নিয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে বিপত্তি

মূল শ্রম আইনে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ৩০ শতাংশের সম্মতি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান ছিল। ২০১৮ সালে আইন সংশোধন করে বলা হয়, শ্রমিকদের ২০ শতাংশের সম্মতিতেই করা যাবে ট্রেড ইউনিয়ন। তবে আইএলও কনভেনশনে ট্র্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো শতাংশের কথা নেই উল্লেখ করে ইইউ বলেছে, বাংলাদেশকে এই হার ১০ শতাংশ বা ১০ জনের মধ্যে যেটি সর্বনিম্ন, সেই জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।

কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানপুঞ্জে কোনো সময় তিনটির বেশি ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে না, এটিও আইনে রয়েছে। এ বিষয়ে ইইউ বলেছে যে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের হার ৯০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকাসহ অন্যান্য শ্রম আদালতে মামলার যে জট আছে, তা কমাতে হবে।

জানতে চাইলে বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, আইএলও কনভেনশনের মূল চেতনা মেনে ট্রেড ইউনিয়ন করতে কাউকেই বাধা দেওয়া হয় না। দর-কষাকষি করার জন্য সংখ্যা বেশি থাকাই ভালো। তবে দেশীয় বাস্তবতা যেমন মানতে হবে, ইইউর চাওয়াকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পোশাকের বাইরের খাতের শ্রম অধিকার নিয়ে কথা বলার সময় এলেও এ নিয়ে সবাই চুপচাপ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ

আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের ২০১৯ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সমাপনী অধিবেশনে পাকিস্তান, ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান ও ব্রাজিলের শ্রমিক প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আইএলও কনভেনশন না মানার অভিযোগ তোলেন। তাঁদের অভিযোগ হচ্ছে, আইএলও কনভেনশনের ৮১, ৮৭ ও ৯৮ ধারা বাস্তবায়ন করছে না বাংলাদেশ। রূপরেখা তৈরির ব্যাপারে ইইউ যে ৯টি প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলোর ৬টির সঙ্গেই ওই পাঁচ দেশের অভিযোগের মিল রয়েছে।

আইএলও কনভেনশনের ওই তিন ধারায় অবাধ সংগঠন করার অধিকার দেওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকেরা মারা গেলে বা পঙ্গু হলে সেই সময় থেকে গড় আয়ু হিসাব করে তিনি যত দিন কর্মক্ষম থাকতেন এবং সেই সময়ে যে আয় করতেন, তার হিসাব করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রূপরেখা তৈরিতে বিষয়টি আনা হয়নি বলে জানা গেছে।

শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানায় কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে বা পঙ্গু হলে একজন শ্রমিককে দেওয়া হবে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। একজন মানুষের জীবনের দাম কি এটুকু?’ আইএলও কনভেনশন ও ইইউর দাবি মেনে শ্রম আইন সংশোধনের পরামর্শ দেন তিনি।