৫২ ধরনের রোগে ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত বিমাসুবিধা

কোভিডে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের জুলাই মাসে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা রূপম সরকার। খুব বেশি দিন থাকতে হয়নি তাঁকে, দিন পাঁচেক। কিন্তু তাতেই প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায় তাঁর। আর যাঁদের আইসিইউ পর্যন্ত যেতে হয়েছে বা উচ্চমাত্রার (হাই ফ্লো) অক্সিজেন নিতে হয়েছে, তাঁদের খরচ হয়েছে আরও অনেক বেশি। এই বাস্তবতায় অনেকেই স্বাস্থ্যবিমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন।

কিন্তু মহামারি বিমার আওতার বাইরে। এটা বিমার সর্বজনীন নিয়ম। বিমা দলিলেই সে কথা স্পষ্ট উল্লেখ থাকে। তবে কোভিড মহামারি শুরুর পর দেশের প্রায় সব বিমা কোম্পানি কোভিডজনিত মৃত্যুতে বিমাসুবিধা দিয়েছে। মেটলাইফ স্বাস্থ্যবিষয়ক হেল্পলাইন বা গ্রাহক সেবায় বিশেষ ফোন লাইন চালু করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এবার নিয়ে এসেছে গুরুতর রোগ সুরক্ষা বিমা বা ক্রিটিক্যাল ইলনেস ইনস্যুরেন্স প্রোটেকশন প্ল্যান।

বাংলাদেশে চিকিৎসা বাবদ ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ, ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ, চিকিৎসা বাবদ গড়ে ১০০ টাকা ব্যয় হলে তার ৭২ শতাংশই খরচ করছেন ব্যক্তি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এই খরচ মালদ্বীপে ১৮, ভুটানে ২৫, শ্রীলঙ্কায় ৪২, নেপালে ৪৭, পাকিস্তানে ৫৬ ও ভারতে ৬২ শতাংশ। বিগত প্রায় দেড় যুগের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাত বরাবরই অবহেলার শিকার। এই সময়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ৪ দশমিক ২ থেকে ৬ দশমিক ৮ (গড়ে ৫ দশমিক ৫) শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে এবং জিডিপির সাপেক্ষে তা সব সময়ই ১ শতাংশের নিচে। ফলে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।

দেশে গুরুতর রোগে যারা আক্রান্ত হয়, তাদের ৯০ শতাংশই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। সরকারি হাসপাতালে গুরুতর রোগের চিকিৎসা মেলে না বললেই চলে। বাস্তবতা হলো, বড় কোনো অসুখে পরিবার পথে বসে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে দেশে স্বাস্থ্যবিমার ব্যাপক প্রসারের সম্ভাবনা থাকলেও, বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই।

এমন পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে গুরুতর রোগ সুরক্ষা বিমা চালু করেছে মেটলাইফ বাংলাদেশ। স্বাস্থ্যবিমা পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে ৫২টি রোগকে এই বিমার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এসবের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যানসার, কিডনি রোগের মতো গুরুতর প্রাণঘাতী রোগ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পক্ষাঘাত, বাক্​শক্তি লোপ, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো রোগও। এ ছাড়া এ বিমার আওতায় রয়েছে মৌসুমি রোগ ডেঙ্গুও।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে দেশে হৃদ্​রোগে মারা গেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন। স্ট্রোকে মারা গেছেন ৪৫ হাজার ৫০২ জন। ক্যানসারে মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিমার চাহিদা বাড়ছে। দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মানুষের অসুস্থতাজনিত মৃত্যুর একটি তালিকা তৈরি করেছে মেটলাইফ। সেই তালিকার ভিত্তিতে ৫২টি রোগকে বিমার আওতায় আনা হয়েছে।

জানতে চাইলে মেটলাইফ বাংলাদেশের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান বলেন, ‘কোভিডকালে আমরা দেখেছি, মানুষ গুরুতর রোগের বিমা চায়। মানুষের সেই চাহিদা পূরণেই আমরা এই বিমাসুবিধা চালু করেছি। এই বিমা নিয়ে ইতিমধ্যে বিক্রয় প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আশা করছি মানুষও এই বিমা নিতে আগ্রহ দেখাবে।’

এই বিমার বিশেষ দিক হলো, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর হলেও এই বিমার সুবিধা ৮০ বছর পর্যন্ত দেওয়া হবে। বিমার মেয়াদ সর্বোচ্চ ২০ বছর। ৩০ বছর বয়সে কেউ এই বিমা নিলে প্রিমিয়াম দিতে হবে সর্বোচ্চ ২০ বছর, অর্থাৎ সেই ব্যক্তির ৫০ বছর বয়সে এই বিমার মেয়াদ শেষ হলেও তিনি আরও ৩০ বছর বা ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত বিমাসুবিধা পাবেন।

৫২টি রোগ অবশ্য দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ৩৪টি রোগকে জটিল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আর ১৮টি রোগকে অপেক্ষাকৃত কম জটিল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম জটিল ১৮টি রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এককালীন বিমাসুবিধা দেওয়া হবে। আর ৩৪টি গুরুতর বা জটিল রোগের চিকিৎসা বা বিমাগ্রহীতার মৃত্যুতে পুরো বিমা অঙ্ক দেওয়া হবে। এ ছাড়া দুর্ঘটনা ও স্বাভাবিক মৃত্যুতে বিমা অঙ্কের পুরো অর্থই পাবেন গ্রাহক।

এ ছাড়া এখন ডেঙ্গুর মৌসুম হওয়ায় এ রোগের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হবে। বলা হয়েছে, ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু হলে বিমা অঙ্কের সঙ্গে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ অর্থ দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলেন, দেশে যেসব জটিল রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়, সেই সব রোগের বিমা থাকলে মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। তবে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে সক্ষমতা।