৯টি গভীর নলকূপেই ১২০ কোটি টাকা

গভীর নলকূপ স্থাপন; বাস টার্মিনাল, সড়ক ও সেতু নির্মাণ প্রকল্পে এলজিইডির অনুমাননির্ভর ব্যয় প্রস্তাব। তা দেখে পরিকল্পনা কমিশন বিস্মিত।

এলজিইডি

একটি সরকারি প্রকল্পের আওতায় দেশের ৩টি পৌরসভায় মাত্র ৯টি গভীর নলকূপ বসানো ও সেগুলো থেকে পানি সরবরাহে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। এতে একেকটি গভীর নলকূপের পেছনে ব্যয় পড়ছে ১৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

আবার দুটি বাস টার্মিনালের পরিসর বৃদ্ধি ও আরেকটি নতুন করে নির্মাণে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা। একইভাবে ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রস্তাব করা হয় ১৯৫ কোটি টাকার তোঘলকি ব্যয়।

‘আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিটি গভর্ন্যান্স’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় এভাবেই বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের বিপরীতে ‘অনুমাননির্ভর’ খরচ দেখিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সরকারি সংস্থাটি একই প্রকল্পে সেতু, ওভারপাস ও উড়ালসড়ক নির্মাণ, সফটওয়্যার তৈরি এবং পরামর্শক ব্যয়ও বেশি ধরেছে। সরকারি টাকা খরচের অমন বাহার দেখে পরিকল্পনা কমিশন বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে কমিশন প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি এ রকম খরচের প্রস্তাবকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে উল্লেখ করেছে।

এলজিইডির প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়ে পরিকল্পনা কমিশন সবকিছুর নকশা তৈরি ও বিস্তারিত সমীক্ষা করে তবেই ব্যয় নির্ধারণ করতে বলেছে। এলজিইডির কর্মকর্তারাও অবশ্য স্বীকার করছেন, তাঁরা যে ব্যয় ধরেছেন, তা অনুমাননির্ভর ও সাময়িক। বলছেন, দরপত্র আহ্বানের সময় খরচ কমতে পারে।

এলজিইডি নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এবং কক্সবাজার পৌরসভায় অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক কর্মকাণ্ডের এই প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ দেবে ২ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা সরকার বহন করবে।

■ ৩টি বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ, স্থানান্তর ও নির্মাণে ১৫২ কোটি টাকা। ■ ৯টি গভীর নলকূপ স্থাপনে মোট ১২০ কোটি টাকা। ■ ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় ১৯৫ কোটি টাকা। ■ প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয় ৩৭৩ কোটি টাকা। ■ একেকটি সফটওয়্যারে ব্যয় ২৭ লাখ টাকা।

একটি গভীর নলকূপে ১৩ কোটি

প্রকল্পটির আওতায় কক্সবাজার পৌরসভায় পাঁচটি আর কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে দুটি করে গভীর নলকূপ বসানো ও পানি সরবরাহে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছে এলজিইডি। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ৯টি গভীর নলকূপ স্থাপন ও পানি বিতরণ ব্যবস্থার জন্য এত টাকা খরচ হওয়ার কোনো কারণই প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়নি।

একেকটি নলকূপ বসাতে ১৩ কোটি টাকার বেশি খরচ ধরার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, এটা তো সাময়িক হিসাব। অনুমান করে ঠিক করা হয়েছে। পরে আন্তর্জাতিক পরামর্শক ঠিক করে হিসাব চূড়ান্ত করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াসা যেভাবে পানি সরবরাহ করে গ্রাহকের কাছে দেয়, আমরাও সেভাবে করব। আমরা গভীর নলকূপ স্থাপন করে গ্রাহকের কাছে বিতরণ পর্যন্ত পুরো কাজই করব।’

সাধারণত পৌরসভায় গভীর নলকূপ বসানোর কাজ করে থাকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)। জানতে চাইলে ডিপিএইচইর ‘৪০ পৌরসভায় পানি সরবরাহ’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক সরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যদি ভূ-উপরিভাগের পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট নির্মাণ করে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে মোট খরচ পড়বে ৭ থেকে ১০ কোটি টাকা। আর যদি গভীর নলকূপ বসিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে ভূগর্ভের পানি কয়েক শ মানুষের মধ্যে বিতরণের প্রকল্প নেওয়া হয়, তাতে সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ৫০ লাখ টাকার মতো।

টার্মিনাল সম্প্রসারণ ও নির্মাণ

আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিটি গভর্ন্যান্স প্রকল্পের আওতায় দুটি বাস টার্মিনালের সম্প্রসারণ ও নতুন আরেকটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতিটি বাস টার্মিনালের পেছনে বরাদ্দ পড়ছে ৫০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাস টার্মিনালগুলোর লেআউট বা নকশা চূড়ান্ত না করে কীভাবে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

যানজট কমাতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকার শাসনগাছা থেকে বাস টার্মিনাল সরিয়ে আলেখারচরে নিতে চায় এলজিইডি। আবার একই সিটিতে বিদ্যমান জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনালের পরিসর বাড়ানো হবে। দুটি বাস টার্মিনালের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১০১ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়েম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, আলেখারচরে বাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে উন্নয়নও করতে হবে। এর সঙ্গে অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণও রয়েছে।

অন্যদিকে কক্সবাজার পৌরসভার বিদ্যমান বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সেখানকার প্যানেল মেয়র হেলাল উদ্দিন কবির। পৌরসভার নিজস্ব জমিতেই সম্প্রসারণ করা হবে। এ জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৫১ কোটি টাকা।

৬ কিমি সড়ক নির্মাণে ১৯৫ কোটি

তিন সিটি করপোরেশন ও একটি পৌরসভায় মোট ছয় কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে এলজিইডি। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১৯৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে খরচ পড়বে ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই খরচকে অত্যধিক আখ্যায়িত করে পরিকল্পনা কমিশন বিস্তারিত সমীক্ষা চালিয়ে তবেই ব্যয় প্রস্তাব নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে।

প্রকল্পটির আওতায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ৬৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি রেলওয়ে ওভারপাস ও ৮০০ মিটারের একটি উড়ালসড়ক; গাজীপুর সিটি করপোরেশনে একটি ৬৩০ মিটারের রেলওয়ে ওভারপাস এবং টঙ্গীতে তুরাগ নদের ওপর ১০০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। এসব সেতু, ওভারপাস ও উড়ালসড়কের কোনো নকশা চূড়ান্ত না করেই অনুমানের ভিত্তিতে ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। সে জন্য পরিকল্পনা কমিশন বিস্তারিত সমীক্ষা চালিয়ে ও নকশা চূড়ান্ত করে তারপর খরচ নির্ধারণ করতে বলেছে।

সফটওয়্যার তৈরির প্রকল্প

এ ছাড়া প্রকল্পটির আওতায় তিন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাটির জন্য মোট ৭৫টি সফটওয়্যার তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতিটি সফটওয়্যার তৈরিতে গড়ে খরচ পড়বে ২৭ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রেও ব্যয় বেশি দেখানো হয়েছে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন।

এসব সফটওয়্যার তৈরির কারণ সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য তৈরি করা হবে এসব সফটওয়্যার। সিটি করপোরেশনের সম্পদ ব্যবস্থাপনা, কর আহরণ, জমির হিসাব রাখা—এসবের জন্য আলাদা আলাদা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে।

পরামর্শক ব্যয় ৩৭৩ কোটি টাকা

জানা গেছে, এই প্রকল্পের পরামর্শকের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৭৩ কোটি টাকা। এমন একটি দেশীয় প্রকল্পে কেন পরামর্শক খাতে এত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের কাছে নকশা ও বিস্তারিত সমীক্ষা চেয়েছি। সে জন্য অপেক্ষা করছি।’ পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানোর আগে কেন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করা গেল না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাজ এখন হচ্ছে। জাইকার পরামর্শক বিভিন্ন খাতে এসব খরচ ধরেছে।

এই প্রকল্পের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের ব্যয় এ রকম: ভূমি অধিগ্রহণ ৫৪৬ কোটি, প্রকৌশল ও যন্ত্রপাতি ৫২২ কোটি, পানিনিষ্কাশন ড্রেন নির্মাণ ৩৬০ কোটি, জমি ভরাটসহ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ৩১৬ কোটি, স্ট্রিট লাইট বা সড়কবাতি ৭১ কোটি, শেড ও খেলার মাঠ ৫০ কোটি এবং আউটসোর্সিং ৬০ কোটি টাকা।

সামগ্রিক বিষয়ে সরকারি কেনাকাটা সংক্রান্ত সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য বা উপকরণের বাজারমূল্য কত, সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো ধারণাই নেই। বাজারে না গিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পে পণ্যের দাম ধরা হয়। বাজারে না গিয়ে টেবিলে বসে এ ধরনের বাজেট করলে পণ্যের দাম তো বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক হবেই।