বিদ্যমান করপোরেট কর ব্যবস্থা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে মনে করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশনএইড। এ সংস্থাটি বলছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কৌশলে কর এড়িয়ে যাওয়ায় বড় অঙ্কের রাজস্ব হারায় বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো। জটিল বিধি ও আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে এসব কোম্পানি তাদের আয়কর খাতা এমনভাবে সাজিয়ে রাখে, যাতে বড় অঙ্কের কর দেওয়ার দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারে। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার আমূল সংশোধন জরুরি।
গতকাল রোববার অ্যাকশনএইডের প্রকাশিত ‘সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা: দায়িত্বপূর্ণ করপোরেট কর ব্যবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর এক হোটেলে আলোচনা সভার আয়োজন করে অ্যাকশনএইড। সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পরিচালক আসগর আলী সাবরি।
এ সময় আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকার ডেনমার্ক দূতাবাসের ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলর পিটার বগ জেনসেন বলেন, বাংলাদেশ হলো জিডিপির তুলনায় পৃথিবীর সবচেয়ে কম কর আদায়কারী দেশ। একই কাতারে থাকা কেনিয়া, সিয়েরা লিওনেও বাংলাদেশের তুলনায় বেশি কর আদায় হয়। বাংলাদেশে মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এখানে আইন ও নীতি দুর্বল। আর এই সুযোগ নেয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
অ্যাকশনএইডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে করপোরেট কর ফাঁকি ঠেকানো জরুরি। করপোরেট কর ফাঁকির কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় প্রয়োজনীয় কর আদায়ে পিছিয়ে পড়ছে দেশ। জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় বাড়াতে পারছে না সরকার।
কীভাবে করপোরেট কর ফাঁকি হয়—এ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রয়োজনীয় সম্পদ ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন দেশের রাজস্ব আদায়কারী কর্তৃপক্ষকে বহুজাতিক কোম্পানির কর ফাঁকি ঠেকাতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ, বড় বড় কোম্পানির দক্ষ ও সুচারু হিসাবরক্ষক দল নিয়োগ করে রাখে, যাদের কাজই হচ্ছে প্রযোজ্য করের অঙ্ক কোনোভাবেই প্রকাশ হতে না দেওয়া।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ‘বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে হাতে-পায়ে ধরে; গলায় মালা দিয়ে আমরা নিয়ে আসি। কেননা কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ দরকার। তারা (বহুজাতিক কোম্পানি) নানাভাবে অর্থ স্থানান্তরসহ বিভিন্ন বিষয় নানাভাবে বোঝায়। আমরা এগুলোর সব বুঝি না। আবার আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। তা না হলে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় চলে যাবে তারা।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অ্যাকশনএইডের নির্বাহী পর্ষদের চেয়ারপারসন এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিকে কর সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে কর ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। তাই স্থানীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে কর ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনতে হবে।
কর ব্যবস্থার অসামঞ্জস্য তুলে ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, যারা কর নীতি করছে, তারাই কর আহরণ করছে। এটা আলাদা করা প্রয়োজন। তাঁর মতে, কর-জিডিপি অনুপাত কম বলেই বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মতো হচ্ছে। করের অনুপাত জিডিপির ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে পারলে এ বাজেট ঘাটতি থাকত না।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, বর্তমান করপোরেট কর ব্যবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো।
ক্রিশ্চিয়ান এইড এবং অক্সফামের সহযোগিতায় অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট কর ব্যবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদনে মূলত দায়িত্বপূর্ণ কর ব্যবস্থাপনা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অর্থায়ন এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর দেওয়ার মানসিকতা ও করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকি ঠেকাতে আটটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, সুষ্ঠু কর পরিকল্পনার চর্চা; জনগণের প্রতি স্বচ্ছতা ও প্রতিবেদন প্রণয়ন; কর্তৃপক্ষের কাজে জবাবদিহি; কর আরোপ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের উন্নয়ন, সুষ্ঠু কর ব্যবস্থাপনা ও অনুশাসন; কর নীতির পর্যালোচনা; কর সম্পর্কিত প্রভাবন এবং কর প্রণোদনা।