সরকারি চাকরিতে কেন এত আগ্রহ?

সরকারি যে কোনো চাকরির চাহিদা আগের থেকে কয়েক গুন বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাকরির নিরাপত্তার কারণে সরকারি চাকরিতে বাড়ছে আগ্রহ। তবে এর পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদার ব্যাপারটিও সরকারি চাকরির কদর বাড়িয়ে দিয়েছে।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে সম্প্রতি এক যুব-জরিপ চালিয়েছে। জরিপে দেখা গেছে শিক্ষিত যুবদের মধ্যে ৫৭% নারী এবং ৪২% পুরুষ সরকারি চাকরি করতে চান।

সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেয় সরকার। সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) প্রথম শ্রেণির ক্যাডার নিয়োগ দেয়। পাশাপাশি প্রথম (নন-ক্যাডার) ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগও দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

পিএসসি জানায়, আগের তুলনায় বর্তমানে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগের হার বছর বছর বেড়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ক্যাডার নিয়োগ দিয়েছে ১৬ হাজার ৩৬৫ ও নন-ক্যাডার নিয়োগ দিয়েছে ৩ হাজার ৮৯০ জনকে।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৬ হাজার ৫৪২ জন প্রথম শ্রেণির ক্যাডার পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। নন-ক্যাডার থেকে সুপারিশ করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৭৬ জন। সব মিলিয়ে গত ১০ বছরে ৬০ হাজার ১১৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। এই হারই বলে দেয় পিএসসি আগের তুলনায় বেশি নিয়োগ দিচ্ছে। কেবল সরকার যে নিয়োগ দিচ্ছে তা নয়, দিন দিন সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহও বাড়ছে মানুষের।

সর্বশেষ ৪০তম বিসিএসে ২ হাজার ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের বিপরীতে চার লাখের বেশি প্রার্থী আবেদন করেন। এটি এখন পর্যন্ত বিসিএসে আবেদনের রেকর্ড।

তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিসিএসের পাশাপাশি সরকারি চাকরি যেমন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দুদক, রাজস্ব বোর্ড, প্রাথমিকের শিক্ষক, খাদ্য অধিদপ্তর, সাব রেজিস্ট্রার, সমাজসেবা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে চাকরি প্রার্থীদের আগ্রহ আছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিদর্শকের (এসআই) নয়টি শূন্য পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন ৭৮ হাজার ৮২ জন। প্রতি পদের বিপরীতে আবেদনের সংখ্যা আট হাজার ৬৭২টি। এসআই পদে সব মিলিয়ে বেতন প্রায় ২৬ হাজার টাকা।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ১২ ধরনের ২৪২টি পদে কর্মকর্তা ও সদস্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর আবেদনের সংখ্যা দেখে কর্মকর্তারা অবাক হয়েছেন। ২৪২টি পদের বিপরীতে মোট ২ লাখ ১৭ হাজার আবেদন পড়েছে। অবস্থা এমনই যে আবেদনগুলোর প্রাথমিক যাচাই (শর্ট লিস্ট) করাও সংস্থাটির পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সর্বশেষ ১১ হাজার শিক্ষকের নিয়োগে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ২৬ লাখ। পরীক্ষা নিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে। পাঁচবার পরীক্ষা পেছানোর পর চার দফায় আলাদা আলাদা তারিখে ভাগ করে পরীক্ষার আয়োজন করা হয়।

খাদ্য অধিদপ্তরের ১ হাজার ১০০ জন নিয়োগের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ১৫ লাখ। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, কীভাবে এত মানুষের পরীক্ষা নেওয়া হবে তা নিয়ে তাঁরা বেশ চিন্তিত। ২৪ ধরনের পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়ে সহকারী খাদ্য পরিদর্শক (এএফআই) পদে। এর ২৭৪টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন পড়ে ছয় লাখ ৩৩ হাজার ৯৫২টি। এর অর্থ প্রতিটি পদের জন্য লড়বেন দুই হাজার ৩১৩ জন। এরপরই রয়েছে খাদ্য পরিদর্শকের পদ। এর ২৫০টি পদের জন্য প্রতিযোগিতা করবেন চার লাখ ১১ হাজার ৮৯৬ জন। অর্থাৎ প্রতিটি পদের জন্য লড়বেন এক হাজার ৬৪৭ জন।

ব্যাংক খাত
গত বছরের অক্টোবরে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকে ৭ হাজার ৩৭২ কর্মকর্তা নিয়োগে ১০ লাখের বেশি প্রার্থী চাকরির আবেদন করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিয়োগসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) বলছে, ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে এর আগে একসঙ্গে এত প্রার্থী আবেদন করেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ১ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এই তালিকা থেকে অনেকে নিয়োগও পেয়েছে। অন্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান।

বিসিএসসহ সব সরকারি চাকরির আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, দিন দিন মানুষের সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। সরকারি চাকরিতে বেতন বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এসব চাকরিতে আগ্রহ বেড়েছে।

ব্যাংকের চাকরি আকর্ষণীয় হওয়ায় ব্যাংকে আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, বেশি বেতন, চাকরির নিশ্চয়তা, নানা ধরনের ঋণ-সুবিধা থাকার কারণে ব্যাংকের চাকরি তরুণদের প্রথম পছন্দ। তবে আবেদন বাড়ার আরেকটি কারণ বেকারত্ব।

ব্যাংকে এত বিপুল আবেদনের কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির (বিএসসি) প্রধান মোশাররফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বিত পদ্ধতিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার কারণে আবেদন বেড়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকে আবেদন বাড়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে এ জন্য কোনো টাকা লাগছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলা প্রশাসক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিতে আগে আগ্রহ কম ছিল। এখন বেসরকারি চাকরিতে নিরাপত্তা নেই। তাই সরকারি যে কোনো চাকরিতেই আগের থেকে বেশি আবেদন জমা পড়ছে। যেসব পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাশ সেখানে এসএসসি বা এইসএসসি পাশ প্রার্থীরা আবেদন করছেন। আবার যেখানে এসএসসি বা এইসএসসি পাশ যোগ্যতা চাওয়া হচ্ছে সেখানে অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করা প্রার্থীরা আবেদন করছেন। আমরা যখন মৌখিক পরীক্ষায় জিজ্ঞাসা করি কেন এই অল্প যোগ্যতার চাকরিতে আবেদন করেছেন। চাকরি প্রত্যাশীরা এর উত্তরে বলছেন চাকরির নিরাপত্তা বা সামাজিক মর্যাদার কথাটি। আর এটা সত্য যে সরকারি চাকরিতে বেতন বেড়েছে তাই এতে ছোট বা বড় সব পদেই চাকরি করার আগ্রহী হচ্ছে মানুষ।