পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লে চাকরির পরীক্ষা সহজ হয়

তৌহিদ এলাহী
তৌহিদ এলাহী
>

বাংলাদেশের তরুণেরা তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে নানা ধরনের স্বপ্ন দেখেন। কেউ কেউ বিসিএস ক্যাডার হতে চান, কেউবা আইবিএ বা ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে এমবিএ করে করপোরেট জগতে রাজত্ব করতে চান। আবার কেউ যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা উন্নত দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী। ৩০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা তৌহিদ এলাহী ধাপে ধাপে তিনটি সুযোগই গ্রহণ করেছেন। নানামুখী অর্জন, কর্মকাণ্ড ও পড়াশোনাপদ্ধতি প্রভৃতি নিয়ে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোছাব্বের হোসেন। 

প্রশ্ন: আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?

তৌহিদ এলাহী: স্কুলজীবন কাটিয়েছি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় আমার গ্রামের জোরখালী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোরখালী উচ্চবিদ্যালয়ে। এখান থেকে ২০০২ সালে জিপিএ-৩.৭৫ নিয়ে এসএসসিও ২০০৪ সালে জিপিএ-৪.৭০ নিয়ে সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ জামালপুর থেকে এইচএসসি পাস করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করি। ২০১১ সালের জুনে আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএর নিয়মিত প্রোগ্রামে ভর্তি হই। ছাত্রজীবনেই খণ্ডকালীন সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে জড়িত হই। বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে ফিচার রাইটার, প্রদায়ক হিসেবে কাজ করি। বিসিএস প্রশাসনে প্রথম পোস্টিং ছিল লক্ষ্মীপুর জেলায়। পরবর্তী সময় ঢাকা জেলা প্রশাসনে কাজ করার সুযোগ পাই। ঢাকা জেলায় কাজ করার সময় এমবিএ প্রোগ্রামকে খণ্ডকালীন হিসেবে পরিবর্তন করে ফাইন্যান্স মেজরসহ এটি শেষ করি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য বুশ স্কুল অব পাবলিক সার্ভিস ও গভর্নমেন্টে বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে দুই বছর মেয়াদি মাস্টার অব পাবলিক সার্ভিস ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা শেষ করেছি।

প্রশ্ন: কীভাবে বিসিএসে এলেন?

তৌহিদ এলাহী: ছাত্রজীবনটা সময় কাটিয়েছি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে, ফিচার লিখে, মুভি দেখে, খেলাধুলা করে ও আড্ডা দিয়ে। বরাবরই পড়ার অভ্যাস ছিল। খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার আমার অভ্যাস, বিশেষ করে উপসম্পাদকীয়গুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। এ ছাড়া নানা দেশি-বিদেশি সাহিত্যসহ চোখের সামনে যা আসত, পড়ে ফেলতাম। প্রতিদিন ২/৩টা বাংলা-ইংরেজি সংবাদপত্র পড়া হয়। পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লে চাকরির পরীক্ষা সহজ হয়। বিসিএস নিয়ে আগে খুব বেশি ধারণা বা আশা ছিল না। অনার্স পরীক্ষার পর বন্ধুদের সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করে ফেলি। প্রিলিমিনারিতে টিকে যাই। মাস্টার্স পরীক্ষার কিছুদিন আগে লিখিত পরীক্ষা ছিল। সেখানেও টিকে যাই। ২০১১ সালে প্রায় কাছাকাছি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ ভর্তি ও ৩০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। বিসিএস ভাইভার কিছুদিন আগে আইবিএতে চান্স পাই এমবিএ করার জন্য। চাকরিতে যোগদানের আগেই এক সেমিস্টার শেষ করে ফেলি। ৩০তম বিসিএসের ফলাফলে প্রশাসন ক্যাডারে ২১তম স্থান অর্জন করি।

প্রশ্ন: বিসিএস, আইবিএ বা উচ্চশিক্ষার জন্য জিআরই ও টোফেলের প্রস্তুতি কি আলাদা নিয়েছিলেন?

তৌহিদ এলাহী: না, সে রকম নয়। আসলে প্রথমেই সিনিয়র ও বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় বুঝতে পেরেছি ভাষা ও গণিতে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে বাকি সব বিষয় বেশ সহজ হয়ে যায়। ভালোভাবে ইংরেজি ও গণিত জানলে আইবিএ অ্যাডমিশনের জন্য অল্প কিছুদিন অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি, ক্রিটিক্যাল রিজনিং চর্চা করলেই হয়ে যায়। টোফেল শুধু ইংরেজি দক্ষতা। জিআরই সরাসরি গণিত ও ভাষা দক্ষতা। বাংলা ভাষার ভালো চর্চা থাকলে বিসিএসের অন্যান্য বিষয়ে স্বল্পতম সময়ে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। অর্থাৎ এ দুটি বিষয়ে ভালো দক্ষতা থাকলে যেকোনো প্রতিযোগিতায় সফলতা সহজ। আমার এসএসসিতে ইংরেজিতে ‘সি’ গ্রেড ছিল, তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য। সেটি পরে কাজে এসেছে সব জায়গায়। আমার মনে হয়েছে, এ দুটো বিষয় সময় নিয়ে লেগে থাকতে হবে, হুট করে এগুলোতে উন্নতি করা সম্ভব নয়। তাই ভাষা দক্ষতার জন্য গ্রামার, ভোকাবোলারি, পত্রিকা পড়েছি। ইংরেজি সাব টাইটেলসহ মুভি দেখা আর বলার দক্ষতার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে ইংরেজি চর্চা করেছি। লেখার জন্য শব্দের প্রয়োগ, বাক্যের বিন্যাস, বাগধারা, প্রবাদ ইত্যাদিতে বৈচিত্র্য আনতে বেশ প্র্যাকটিস করতাম। গণিতের জন্য ক্লাস টেন স্ট্যান্ডার্ড পর্যন্ত অঙ্ক বই সমাধানের করলে অনেক ভালো বেসিক হয়। বিএসএস, আইবিএ ভর্তি পরীক্ষা এবং জিআরইতে গণিতের স্ট্যান্ডার্ড কাছাকাছি মনে হয়েছে। যে কেউ ভালো করে একটি পরীক্ষার জন্য গণিত চর্চা করলে বাকিগুলোও হয়ে যায়। এর বাইরেও পরীক্ষার সিলেবাসের প্রয়োজন অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের কিছু অংশ দেখে নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমাধান বই না দেখে নিজে নিজে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। প্রথম প্রথম কঠিন মনে হলেও চর্চা করতে থাকলে একসময় ঠিকই দক্ষ হওয়া যাবে। এর বাইরে যেকোনো ধরনের এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য বিষয়ভিত্তিক মোটামুটি একটা ধারণা নেওয়ার পর যত বেশি সম্ভব প্রশ্ন, মডেল প্রশ্ন সমাধান করা যেতে পারে। এতে বেশি মনে থাকে। সময় থাকলে বিসিএসের জন্য ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেনের সমাজ, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস—এই ধরনের বিষয়ের বইগুলো দেখে নিলে ভালো ধারণা আসে। এই সামগ্রিক অ্যাপ্রোচ আমাকে সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম চান্সেই সফলতা লাভ করতে সহায়তা করেছে।

প্রশ্ন: এ ধরনের পরীক্ষায় সফলতার জন্য তরুণদের জন্য পরামর্শ কী?

তৌহিদ এলাহী: সবচেয়ে বড় পরামর্শ হচ্ছে আগ্রহীদের পড়ার টেবিল-চেয়ারে দীর্ঘ সময় দিতে হবে। একজন পূর্ণকালীন ছাত্র হিসেবে গড়ে সপ্তাহে ৪০-৫০ ঘণ্টা পড়াশোনায় সময় দেওয়া নৈতিক কর্তব্য। আমাদের দেশে যাঁরা ভালো মুখস্থ করতে পারেন, তাঁরা অল্প পড়ে ভালো রেজাল্ট করে গর্ব করার সুযোগ পেলেও উন্নত দেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সুযোগ নেই। সবাইকে পড়তে বাধ্য করা হয়। আমাদের যদি বাধ্যতামূলক না হয়, তবুও স্বেচ্ছায় এটি করা উচিত। আমাদের বড় শহরগুলোতে প্রচুর জ্যাম। তাই যানবাহনে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। তাহলে পড়ার জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, টিউশনি ও অন্যান্য কাজে সপ্তাহে গড়ে ১০-১৫ ঘণ্টা জার্নি করতে হতো। আমি সে সময়টি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। আর এটি সারা দুনিয়ার খুব জনপ্রিয় একটি ব্যাপার। বিসিএস, আইবিএ অ্যাডমিশন, জিআরই বা টোফেলের জন্য কোচিং করা হয়নি। এসব পরীক্ষার সিলেবাস সম্পর্কে ধারণা হলে এরপর সময় দিয়ে বুঝে বুঝে পড়লেই হয়। পড়াশোনার সব স্তরেই গণিত ও ভাষার চর্চাটা সর্বদা বজায় রাখা উচিত।

প্রশ্ন: ভাইভা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

তৌহিদ এলাহী: আইবিএ ভর্তি পরীক্ষায় ক্যারিয়ার, লক্ষ্য, লিডারশিপ কোয়ালিটি এবং অর্জিত জ্ঞান কীভাবে কোথায় কাজে লাগবে, সেটা জিজ্ঞেস করেছিল। টেক্সাস এঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে সিলেক্ট করার পর স্কাইপে ভাইভা হয়েছে। প্রায় একই ধরনের প্রশ্ন করেছে। আমার মনে হয়েছে, তারা আমার কথা বলা, ব্যক্তিত্বের ধরন, নেতৃত্বগুণ ও আত্মবিশ্বাস প্রভৃতি দেখতে চেয়েছে। তেমন কোনো মুখস্থ টাইপের তথ্যনির্ভর কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। তবে বিসিএস পরীক্ষার ভাইভায় অনেক সাধারণ জ্ঞান জিজ্ঞেস করেছিলেন। বেশ কিছু উত্তর পারিনি। সহজ ও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছি। মুখস্থের বাইরে কিছু কনটেক্সট-নির্ভর প্রশ্ন করেছিল, সেগুলোর উত্তর ভালো হয়েছিল। সবগুলো ভাইভাতে ইংরেজি বলার দক্ষতা আলাদা সুবিধা করে দিয়েছে।

প্রশ্ন: আপনার সর্বশেষ কী খবর?

তৌহিদ এলাহী: সবে মাত্রই ইউএসএর টেক্সাস এঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমপিএসএ ডিগ্রি শেষ করলাম। বুশ স্কুলে আমার এখানকার পড়ার মূল বিষয় ছিল এনার্জি, টেকনোলজি ও সাইবার সিকিউরিটি পলিসি। আমার আগের সায়েন্সের ও বিজনেসের পড়াশোনা অর্জিত জ্ঞান এখানে বেশ কাজে লেগেছে। এখানে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের নানা ডিসিপ্লিনের ছেলেমেয়েরা নিজেদের একুশ শতকের দক্ষ ও যোগ্য পাবলিক সার্ভেন্ট, এনজিওকর্মী, পলিসি মেকার ও রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তুলছে। দেখে ভালো লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্লাসমেট বন্ধুরা সে দেশের মেয়র, গভর্নর, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর এমনকি সে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য এখন থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছে। অনেকেই ইউএস আর্মি, নেভি, মেরিন, পুলিশ, এফবিআই, সিআইএ বা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ও বিভিন্ন এনজিওতে দীর্ঘদিন কাজ করেছে বা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আমি বুশ স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর এ স্কুলের করিডরে আমার সুবাদে বাংলাদেশি পতাকা স্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত গর্বিত করেছে। এখানকার ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, দেশের অগ্রগতি, সম্ভাবনা ও সমস্যা তুলে ধরতে পেরে অত্যন্ত গর্ব বোধ করেছি। এর বাইরে আমি আগে থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। ২০১৮ সালের বইমেলায় আমার রচিত শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘বইকাটা’ এবং এরপর একটি কমিকস বই বের হয়। আমি ২০২০-এর জুলাইয়ে দেশে ফিরে প্রশাসনের কাজে যোগ দেব।