আমি নারীদের বেশি চাকরি দিই, কারণ...

সাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মালিনী সাবা। প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে মালিনী সাবা লক্ষ্য পৌঁছানোর জন্য সব সময় দৃঢ ও সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। একজন ব্যবসায়ী, একজন নেতা এবং একজন সমাজসেবী হিসেবে মালিনী সাবা নিজের চিন্তাভাবনাগুলো সবার সঙ্গে বিনিময় করেন বা ভাগ করে নেন। নিজের কাজ, ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, লক্ষ্য ও আগামী দিনের পরিকল্পনার কথা ফোর্বস–এর তালিকায় থাকা মালিনী জানিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে। তবে মজার ব্যাপার হলো সফল এই ব্যবসায়ীকে বলা হয় ‘ঘটনাক্রমের উদ্যোক্তা’। তিনি সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তাঁর পথচলা, কর্মী নিয়োগ পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।

সাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মালিনী সাবাছবি: টুইটার

প্রশ্ন :

সাবা গ্রুপ সম্পর্কে যদি একটু বলেন।

মালিনী সাবা: পাঁচ হাজার কর্মীর সাবা গ্রুপ বিশ্বের ২০টি দেশে কাজ করে। আমাদের গ্রুপের ১৫টি কোম্পানি আছে। আমাদের গ্রুপের কৃষির প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ আছে। ধান–চালের ব্যবসা, ফার্মাসিউটিক্যালস ফিন-টেক–এর ব্যবসা আরও শক্তিশালী করাই লক্ষ্য। সোনার খনি খনন, বিনোদন, আবাসন ব্যবসা, পর্যটন খাতেও কাজ করি। আর বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে আমরা আগ্রহী।
সাবা গ্রুপ মুনাফার ৫০ শতাংশ জনহিতকর কাজে ব্যয় করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ও সংস্কৃতি এবং মানবাধিকারের ব্যাপারে আমরা সহায়তা করি। আমাদের গ্রুপে অংশীদারদের মধ্যে কার্গিল, বায়োস্টিল গ্রুপ, কফকো ইন্টারন্যাশনাল, গ্লেনকোর, জিন্দাল স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার, এলজি, মিতসুই অ্যান্ড কোম্পানি এ কাজে সহায়তা করে থাকে।

প্রশ্ন :

স্বনির্ভর মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহন সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে অভিজ্ঞতাটা কেমন?

মালিনী: পণ্যের ব্যবসায় আশ্চর্যজনকভাবে আমি ৩০ বছর পার করলাম। যাত্রাটা আকর্ষণীয়ই ছিল। আমি একদম শুরু থেকে নিজেকে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জায়গাগুলোতে কাজ করেছি। চলতে চলতে শিখেছি। আমি মনে করি, ধীরে ধীরে গৎবাঁধা নিয়মগুলো ভেঙেছি। ‘গণিতে পুরুষদের’ দাপটের জায়গটিও ভেঙেছি। নারীরা না এলে অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোবে না, এটা ভেবেই কাজ করে গেছি।
পণ্যের বাজারের ব্যবসায় কেবল ভারতে নয়, বিশ্বজুড়ে মূলত পুরুষেরা চালাতেন। একজন নারী ব্যবসায়ীকে এ খাতে খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ। আমার অভিজ্ঞতায় নারী ব্যবসায়ীরা পুরুষ ব্যবসায়ীদের চেয়ে এ খাতে ভালো করছেন। আর এটা আমি বলছি, কারণ নারীরা পুরুষদের তুলনায় তুলনামূলক বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ। আর এর কারণে এটা নিশ্চিত করে যে তাঁরা (নারী) ক্ষতি কমিয়ে সামগ্রিকভাবে আরও ভালো মুনাফা করেন।
আমি আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোতে নারীদের বেশি করে চাকরি দিই। কারণ, আমি এখানে নারীদের জন্য একটি ধারা তৈরি করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি যে নারী ব্যবসায়ীরা তথ্যর পেছনে ছোটেন। আর কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ তাঁদের ধারণাগুলো ব্যবহার করে দক্ষ হয়ে ওঠেন।

ব্যবসার পাশাপাশি নানা সমাজসেবামূলক কাজ করেন মালিনী
ছবি: টুইটার

প্রশ্ন :

সাবা গ্রুপ পণ্য ব্যবসাকে ছড়িয়ে দেওয়ার ধারণায় কেন এল?

মালিনী: আমাদের প্রাথমিক বিশ্বাস হলো মানুষ ও সমাজের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করা। আমরা দেখেছি যে স্বাস্থ্যসেবা থেকে খনি খননের ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ দশক দশক ধরে থাকছে। আমরা ফার্মাসিউটিক্যাল, বিনোদন, প্রযুক্তি, আবাসন ব্যবসা, পর্যটন, শোধনাগার এবং সোনার খনির ব্যবসায়ে কাজ করে যাচ্ছি।

প্রশ্ন :

প্রশ্ন: নেতৃত্বের (ব্যবসা খাতে) ক্ষেত্রে আপনাকে ‘প্রবীণ শিল্পী’ বলা হয়। শিল্পের পরিবর্তন কীভাবে দেখেন এবং কোভিড–পরবর্তী পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে কী ভাবছেন?

মালিনী: কোভিড-১৯ ভোক্তার আচরণে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। এটা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। যাঁরা (ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান) এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে নিজেদের তৈরি করবেন, তাঁরাই সত্যিকারের বিজয়ী হিসেবে টিকে থাকবেন। করোনা মহামারিতে গ্রাহকদের মধ্য ব্যয় সচেতনতা বেড়েছে ও কেনাকাটার অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। বাণিজ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রাহকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাজার–শপিং করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এসব পরিবর্তন বেশির ভাগই মহামারি করোনা শেষেও থাকবে। গ্রাহকদের পছন্দগুলোর (বিলাসবহুল ব্র্যান্ড এবং ভ্রমণ) মধ্যে স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিধি এবং ব্যক্তিগত যত্নের দিকে মানুষের নজর থাকবে। সেভাবে আমরা কর্মীদেরও নিয়োগ দেব আর দিচ্ছিও।

প্রশ্ন :

আপনার এবং আপনার গ্রুপের পরবর্তী লক্ষ্য কী?

মালিনী: বিশ্বের নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং প্রয়োজনের পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা পথচলার জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা করছি। ওষুধশিল্প ও গুদামজাত শিল্পের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে চাই আমরা।

মালিনী সাবার অ্যাননকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সরবরাহ করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনি কি বড় এবং কার্যকর কিছু করতে চেয়েছিলেন?

মালিনী: আমার উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা ভাগ্যক্রমে শুরু হয়েছিল। আমার বেড়ে ওঠা কষ্টের মধ্য দিয়ে, স্কুলে ভর্তি হওয়া, খণ্ডকালীন কাজ করা এবং বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত (ওড) কাজ করা, খাবারের জন্য সংগ্রাম করা, ঘর ভাড়া দেওয়া এবং ভাইবোনদের যত্ন নেওয়ার পরে আমি বুঝেছি অর্থের মূল্যটা কী। তবে আমি সচেতন ছিলাম, শৈশব থেকেই অভাবী লোকদের জন্য কিছু করার এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জনে আগ্রহী ছিলাম।

প্রশ্ন :

রোল মডেল হওয়ার পথের যাত্রাটি কেমন ছিল?

মালিনী: জীবনের পথচলায় আমরা লোভ–লালসার ঊর্ধ্বে ওঠা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশসহ নানা কিছুই শিখি। আমি পথ চলতে গিয়ে ভালো মনের মানুষের পাশাপাশি নেতিবাচক মানুষও পেয়েছি, অনেক হেনস্তার শিকারও হয়েছি। এরপরও আমি কাজ চালিয়ে গেছি। আমি বুঝেছি পুরুষশাসিত সমাজে কীভাবে টিকে থাকতে হয়।

প্রশ্ন :

উদ্যোক্তা হতে চাওয়া নতুনদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

মালিনী: নতুনদের জন্য আমার পরামর্শ হলো, নানা সমস্যার মধ্য পথ ছেড়ে চলে যাবেন না। কখনো হার মানবেন না, হাল ছাড়বেন না। আপনার নিজের মূল্যবোধ এবং নিজেকে কখনো বিকিয়ে দেবেন না।

শিক্ষাক্ষেত্রেও কাজ করে মালিনীর সংস্থাগুলো
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

অ্যাননকে ফাউন্ডেশনের সম্পর্কে কিছু বলুন?

মালিনী: স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যারা বঞ্চিত, তাদের জন্য কাজ করে অ্যাননকে ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী নানা উদ্যোগের সঙ্গে আছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ, দ্য স্টানফোর্ড মেডিকেল সেন্টার, ওয়াইইউভিএ, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড প্রোগ্রাম, মাদার তেরেসা ফাউন্ডেশন, উইমেন রিফিউজি কমিশনসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে।
আমরা নিয়মিত খাদ্য কর্মসূচি, শিক্ষাবৃত্তি, স্কুল তৈরি, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছি। করোনার টিকা বাজারে এলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশে এটি বিনা মূল্যে বিতরণের পরিকল্পনা করেছে আমাদের এ ফাউন্ডেশন।

প্রশ্ন :

বন্ধু হিসেবে ক্লিনটনের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর ফলে কী কী সুযোগ তৈরি হয়েছে?

মালিনী: ২০ পেরোনোর পর থেকেই আমরা বন্ধু। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রামের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা আফ্রিকায় একসঙ্গে কাজ করেছি। বিল ক্লিনটন করিতকর্মা, চটপটে ও বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের এক জায়গায় এনেছিলেন। বিশ্বের পরিবর্তন আনতে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মধ্য চমৎকার যোগসাজশ তৈরি করেছিলেন তিনি। চলবে...

*আগামীকাল পড়ুন সাক্ষাৎকারের বাকি অংশ: ‘কীভাবে জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেবেন’