বাসমা আলীই গাজাবাসীর চাকরির শেষ ভরসা

বাসমা আলীর জি–গেটওয়েতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন গাজার নারীরা
ছবি: বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইট

ফিলিস্তিন নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভাসে বিশ্বের এক অন্য চিত্র। কফিন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ। পাশে আহাজারি স্বজনের। এটি প্রায় দিনের চিত্র গাজা ও পশ্চিম তীরের। ইসরায়েলের সেনাদের হামলা ও আক্রমণে ফিলিস্তিনের মানুষের এভাবে কেটে যায় দিন। কিন্তু এরই মধ্য এগিয়ে চলে জীবন। সেই যাপিত জীবনে ফিলিস্তিনের নারীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন একজন। তিনি বাসমা আলী। তাঁর প্রশিক্ষণ ও সহায়তার হাত ধরে কাজ পাচ্ছেন নারীরা। করছেন ফ্রিল্যান্সিংসহ নানা ডিজিটাল কাজ।

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ৬১ শতাংশ যুবকের চাকরি নেই বা কর্মহীন। সেখানকার নারীদের চিত্র আরও ভয়াবহ। নারীদের এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে এগিয়ে এসেছেন বাসমা আলী। সঙ্গে পেয়েছেন রাশা আবু সাফিয়াকে। এই দুজন মিলে গড়ে তুলেছেন তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি ‘জি-গেটওয়ে’। বাসমা আলীর এই কোম্পানির যাত্রার লক্ষ্যই হলো নারীদের সহায়তা করা। আর করোনায় পরিবারকে যেন সাহায্য করা যায়, সেটাও তাঁর লক্ষ্য। এখানে প্রশিক্ষণ পেয়ে নানা কাজে জড়িয়েছেন পশ্চিম তীর ও গাজার নারীরা। সমাজ বদলানোর জন্য কাজ করে যাওয়া বাসমা আলী স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নারীদের।
 
বাসমা আলীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি জি-গেটওয়ে গাজায় নারী চালিত প্রথম কোনো প্রতিষ্ঠান। হাজারো বেকার শিক্ষার্থীকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন জি-গেটওয়ের কর্ণধার বাসমা আলী। প্রশিক্ষণেই থেমে থাকতে চান না তিনি। তাই নিজের প্রতিষ্ঠানে ১৫০ জনের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছেন।

জি-গেটওয়ের যাত্রা শুরু থেকে নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করে যাওয়া নিয়ে আত্মবিশ্বাসী নারী বাসমা আলীকে নিয়ে ফিচার প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে। তাদের সামাজিক সব যোগাযোগমাধ্যমেও তা শেয়ার দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) নিয়ে কাজ করার কারণে বাসমার কাজের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বিশ্বব্যাংকের। নারীদের নিয়ে কাজ করা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় পরবর্তী প্রজন্মের নেতার খেতাব পেয়েছেন বাসমা আলী।

২০২০ সালটি ছিল মহামারি করোনাভাইরাসের বছর। সে বছরে ২৬২ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সহায়তা করেছেন বাসমা আলী। আর এতে বেঁচে গেছে ২৬২টি পরিবার। আর ৬১ শতাংশ চরম বেকারত্বের শহর গাজায় এমন উদাহরণ অনুকরণীয়। নারী শিক্ষার্থীদের বেকারত্ব দূর করতে বিশেষভাবে আগ্রহী বাসমা আলী। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখায় সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি পুরস্কারও জিতেছে বাসমা আলীর প্রতিষ্ঠান জি-গেটওয়ে।

করোনার কারণে দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বাসমা আলী। আর নারীদের ডিজিটাল কর্মসংস্থানগুলো ব্যবস্থাও করতে সহায়তা করেছেন। জি-গেটওয়ে তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ১ হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েটকে। দূরশিক্ষণ প্রশিক্ষণের পরে ১৫০ জন দীর্ঘ মেয়াদের চাকরি পেয়েছেন। এই কাজ পাওয়া কর্মীদের বেশির ভাগই নারী, যাঁদের এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাসমা আলী।

বাসমার প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ পাওয়া সাত নারী বিশ্বব্যাংকের একটি বার্ষিক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন নিয়ে এ প্রতিযোগিতায় ২ হাজার ৪০০ জন অংশ নেন। তাঁদের মধ্য বাসমার কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া সাত নারী নিজেদের সেরা প্রমাণ করেছেন। ইউএনডিপি, ইউএন ওমেন এবং হুর্টন স্কুলের জিকলিন সেন্টারের এ আয়োজনে মূল লক্ষ্যই ছিল বিশ্বে নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে কাজ করা।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পরই বিশ্বব্যাংক সহায়তায় এগিয়ে আসে। ১৬ হাজার কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে।

নারীদের জন্য, নারীদের দ্বারা

বাসমা আলী একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী। পড়া শেষের পরই কাজে ঢুকেই তিনি দেখলেন, গাজার প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন তথ্যপ্রযুক্তি গ্র্যাজুয়েট চাকরি ছাড়াই দিন কাটাচ্ছেন। ৬১ শতাংশ চরম বেকারত্বের শহর গাজায় নারীদের চাকরি করার হার আরও কম। আর নানা কারণেই আসলে চাকরি করার হার সেখানে নিম্ন। আর তথ্যপ্রযুক্তির চাকরি পাওয়া তো আরও কঠিন। তবে এ খাতের কাজে নারীদের যোগ্যতা আছে। তাই তিনি নারীদের সুযোগ দিতে কাজ শুরু করেন। বাসমা আলী বলেন, এখানে কর্মসংস্থান বা বেকার সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী। ‘আমি জানি, ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিংয়ের কাজের সুযোগ আছে। আমি তা পেয়েছিও।’ মহামারির সময়ে কম ঝুঁকি আর সীমানা পেরিয়ে কাজ করা যায় বলে তথ্যপ্রযুক্তির খাতে কাজের চাহিদা সর্বদা থাকে। আর যেকোনো সময়ে কাজ করা যায় বলে কাজের সুবিধাও ভালো।

নারীদের নানান সমস্যা নিয়ে বলতে গিয়ে বাসমা বলছিলেন, ‘পুরুষেরা যেকোনো সময় কাজ করতে পারেন। বিদ্যুতের সমস্যা এখানে আছে। বেশির ভাগ বড় সংস্থা সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অফিস চালানোর খরচ বা মূলত বিদ্যুৎ খরচ বহন করতে পারে। তবে ছোট ছোট কোম্পানি বা সংস্থাগুলো তা পারে না, জেনারেটরের সহায়তা নিতে হয়। তাই দিনের বেলা বিদ্যুৎ না থাকলে তারা কর্মচারীদের রাতের বেলা কাজ করতে বলে। আর এখানেই বিপদে আর বিপাকে পড়েন নারীরা। রাতের বেলা বাসা থেকে দূরে থাকতে তাঁদের দেওয়া হয় না। তাই তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারেন ননা। পিছিয়েও পড়েন। পুরুষেরা সব সময় কাজ করতে পারেন।

রাশা আবু সাফিয়া ও বাসমা আলী
ছবি: বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইট

নারীদের ডিজিটাল সুযোগ

দিনে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় বিপদে পড়েন নারীরা। বাড়ির কাজের সূচি, শিশুদের লালনপালন এবং বিদ্যুতের কারণে তাঁরা সমস্যায় পড়ছিলেন। তাঁদের এগিয়ে নিতে কাজ করেছে বাসমার সংস্থা জি-গেটওয়ে। লিঙ্গসমতা অর্জনে নারীদের এসডিজি ৫ অর্জনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে বাসমা। জি-গেটওয়ে গাজার নারীদের ল্যাপটপ সরবরাহ করেছে আর বিদ্যুতের সমস্যাও সমাধান করে দিয়েছে। এতে কর্মচারী এবং প্রশিক্ষণার্থীরা বাসা থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছেন। তবে বিদ্যুতের জন্য অর্থ প্রদান করতে হলেও নারীরা খুশি।

বাসমা বলেছেন, ‘করোনা মহামারির পর বিশ্ব সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থার মুখোমুখি। এই সময়ে নারীদের কর্মশক্তির অংশ হয়ে উঠতে এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে কাজ করছি। আমরা শ্রমজীবী নারীদের নিয়ে কাজ করছি, যেন এসডিজি ৮-এ অবদান রাখতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো আমরা মানুষের জীবন বদলাতে চাই। আমরা চাই তরুণ–তরুণীরা তাদের নিজের নিয়তির নিয়ন্ত্রণ হয়ে উঠুক। বিশ্বকে আরও এগিয়ে নিতে তারা কাজ করুক। ডিজিটাল স্পেস হলো এমন একটি ব্যাপার, যেখানে গাজার মানুষ প্রতিদিন যে যে অসম্ভব বা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, তার বাইরে এসে পরিবর্তনে যেন নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারে। আমার নিজের সংগ্রাম এবং অভিজ্ঞতা আমাকে এগিয়ে যেতে, সংঘাত ও মহামারি সত্ত্বেও বাড়িতে থেকে কাজ পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।’ তথ্যসূত্র: টাইমস ও বিশ্বব্যাংক ওয়েবসাইট