প্রতিবন্ধীদের জন্য অনলাইন চাকরি মেলা

বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অনলাইন চাকরি মেলার আয়োজন করেছিল ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি। মেলাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে আইএলওর স্কিলস ২১ প্রকল্প এবং এফসিডিওর অর্থায়নে ইনোভেশন টু ইনক্লুশন (আই টু আই) প্রকল্পের সহযোগিতায় আয়োজিত হয়। মেলায় কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের এ টু আই প্রোগ্রাম এবং বিডিজবস। মেলার মূল উদ্দেশ্য, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কর্মক্ষম ও দক্ষ প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে কর্মদাতা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ ঘটানো, যেন তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।

আইএলওর স্কিলস ২১ প্রকল্পের আওতায় বিবিডিএন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তাঁদের কর্মমুখী দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে দেশে সাতটি সরকারি কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং দুটি টিচার্স ট্রেনিং সেন্টারকে মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তর করা হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, তাঁদের অভিভাবক, প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক এবং স্থানীয় নিয়োগকর্তাদের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তির সুফলবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি, তাঁদের জন্য ইনস্টিটিউটগুলোকে প্রবেশগম্য করা এবং তাঁদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে।

২৬ জানুয়ারি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে। সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট এবং বিবিডিএনের চেয়ারম্যান আরদাশীর কবির অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। বিবিডিএনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, সংস্থাটি বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের একটি কল্যাণমুখী ট্রাস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১৩ সালের অধিকার ও সুরক্ষা আইন অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিবিডিএন ব্যক্তিমালিকানা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো টেবিলভিত্তিক কাজ ও প্রযুক্তিভিত্তিক চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগের লক্ষ্যে কাজ করছে। মেলায় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশে বলেন, তারা যেন নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশগম্য এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মপরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যায়।

লিওনার্ড চেশায়ারের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ জহির-বিন-সিদ্দীক বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইনোভেশন টু ইনক্লুশন (আই টু আই) প্রকল্প নিয়ে বলেন, এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতে তাঁদের অন্তর্ভূক্তিমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য তথ্যের ঘাটতি একটি বড় সমস্যা। এই প্রকল্পের শুরুতে আমরা চিন্তা করেছি, কীভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন করা যায় এবং বেসরকারি খাতে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। এই প্রকল্পের আওতায় বিডিজবসের সহায়তায় আই টু আই ক্যারিয়ার অ্যাডভাইজার নামে প্রথমবারের মতো শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি জব পোর্টালের উদ্বোধন করে। এই জব পোর্টালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাঁদের সুবর্ণনাগরিক কার্ডের নম্বর দিয়ে নিজেদেরকে নিবন্ধিত করতে পারেন।

বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘বিবিডিএনসহ এ মেলার আয়োজকদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য এবং বিডিজবসকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য। এটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত এবং একটি মাইলফলক। করোনা মহামারির কবলে পড়ে আমাদের অর্থনৈতিক খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি একটি আশীর্বাদ, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য। তাঁরা ঘর থেকে কাজে যোগদানের সুযোগ পাচ্ছেন, যেটা তাঁদের চলাফেরার বাধাকে দূর করে দিচ্ছে।’

এফবিসিসিআই সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা যাঁরা বিভিন্ন ব্যবসায় সংগঠনে আছি, আমাদের একটা নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।’ তিনি আশ্বাস দেন যে যদি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তাঁদের দক্ষতার বিবরণ এবং অবস্থান উল্লেখ করে এফবিসিসিআই বরাবর প্রেরণ করা হয়, তবে তাঁরা অন্যান্য চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে দক্ষতাসম্পন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য উদ্যোগ নেবেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্য কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে যে দর্শনটি আমরা মনেপ্রাণে লালন করি সেটি হচ্ছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই সমাজের অংশ এবং তাঁদের অধিকার এই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন অ্যাডভাইজরি গ্রুপ গঠন করেছি। তাঁদের জন্য রিফ্রেশার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কারিগরি শিক্ষায় ৫ শতাংশ কোটা আছে। তাঁদের কর্মসংস্থানের জন্য জব প্লেসমেন্ট সেলে তাঁদের তথ্য রাখা হয়, যেন সেখান থেকে তাঁদের তথ্য নিয়ে নিয়োগকর্তারা তাঁদের নিয়োগ দিতে পারেন। প্রতিটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন ফোকাল নিয়োগ দেওয়া আছে, যাঁরা এই বিষয় নিয়ে কাজ করেন।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুওমো পৌটিআইনেন বলেন, আইএলও বিশ্বজুড়ে সামাজিক ন‌্যায়বিচার এবং শোভন কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ‌্যে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধকতা যেন তাঁদের কর্মক্ষম হওয়ার পথে বাধা না হয়, এই জন‌্য আইএলও তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষতার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং কর্মক্ষেত্রে শোভন পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ‌্যে বাংলাদেশ সরকার, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মী সংগঠনের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ন কবির (প্রকল্প পরিচাল (যুগ্ম সচিব), এসপায়ার টু ইনোভেট (এ টু আই)) বলেন, ‘আমরা সবাই যে আজকে একটা মঞ্চে একত্রিত হয়েছি, এটি আমাদের সবার প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে কাজ করার যে অঙ্গীকার, তারই বহিঃপ্রকাশ। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ থেকে ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। যেসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরা প্রমাণ করে চলেছেন যে তাঁরা সাধারণ ব্যক্তির চেয়ে কোনো অংশে কম পারদর্শী নন। দরকার শুধু সুযোগ। এই মানুষগুলোকে সুযোগ দেওয়ার ফলে প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি পায়, যেটা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বিবেচনার বিষয় হতে পারে। আমি ধন্যবাদ দিতে চাই এই মেলায় অংশগ্রহণকারী ৬০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে, যারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ করে দিতে এগিয়ে এসেছে।

পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন আজিজা আহমেদ, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক।