বিসিএস মৌখিক দেওয়ার রায় পেতে ১৮ বছর, সুমনা শেষটা দেখতে চান

সুমনা চট্টগ্রামে থাকেন। তিনি বলেন, ভাইভা দিতে গেলে নানা জটিলতা শুরু হয়। বিএনপি না আওয়ামী লীগ—কোন সরকারের আমলে বাবা মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছেন, তা নিয়ে ঝামেলা হয়।
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)
ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসক সুমনা সরকার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ২৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সুমনা সরকারের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অমল কৃষ্ণ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে জটিলতার অভিযোগে পিএসসি সুমনার মৌখিক পরীক্ষা নেয়নি। তবে সুমনা সরকার হাল ছাড়েননি। আইনি লড়াইয়ে জিতেছেন তিনি। দীর্ঘ ১৮ বছর পর আদালতের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সুমনা সরকারের পরীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সুমনা যে ছেলেকে পেটে নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই ছেলে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

সুমনা সরকারের এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি চিকিৎসক বাবা অমল কৃষ্ণ সরকার। তিনি ২০১৮ সালে মারা গেছেন। সুমনা বললেন, ‘বাবা আমাকে পরীক্ষা দিতে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিতেন। পরে আইনি লড়াইয়ে পাশে ছিলেন। গত বছর আমার পক্ষে আদালতের রায় পেলাম, তত দিনে বাবা আর বেঁচে নেই।’

সুমনা বর্তমানে চট্টগ্রামের লায়ন্স দাতব্য চক্ষু হাসপাতালে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। তিনি জানান, এত দিন আইনি লড়াই (আইনজীবীরা আর্থিক খরচে ছাড় দিয়েছেন), মামলার প্রয়োজনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাতায়াত—সব মিলে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।

পিএসসি চাইলে তো আমাকে এমনিতেই নিয়োগ দিতে পারত। তবে আমি শেষটা দেখতে চাই। এ দীর্ঘ সংগ্রামে স্বামী পাশে ছিলেন, আমার পক্ষ হয়ে ঢাকায়, আদালতে গিয়েছেন। তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা।
সুমনা সরকার

২০০০ সালে পিএসসির নেওয়া ২৩তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাডারের প্রার্থী ছিলেন সুমনা। ওই বছরের মার্চে প্রিলিমিনারি এবং এপ্রিলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ২০০৩ সালের জুনে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে জটিলতার অভিযোগে চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষা থেকে বাদ পড়েন তিনি।

সুমনা সরকার
ছবি: সংগৃহীত

সুমনার শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি সেখানেই থাকেন। গত মঙ্গলবার মুঠোফোনে বলেন, ‘ভাইভা দিতে গেলে নানা জটিলতা শুরু হয়। বিএনপি না আওয়ামী লীগ—কোন সরকারের আমলে বাবা মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছেন, তা নিয়ে ঝামেলা হয়। ভাইভা দেওয়ার জন্য পিএসসি অনেককে নাকি আগের দিন নতুন এডমিট কার্ড দিয়েছিল, কিন্তু আমি সে ধরনের কোনো কার্ড পাইনি, তাই পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি।’

সুমনা সরকার বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলার রায় হয়। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করে পিএসসি। আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে দেন। পরে গত বছরের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি হলে পিএসসিকে অসমাপ্ত মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। চলতি বছরের ১ জুন সুমনা সরকার পিএসসির চেয়ারম্যান বরাবর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। ৩০ জুন পিএসসি সচিবালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) নুর আহমদের সই করা চিঠিতে সুমনাকে জানানো হয়েছে, রায় বাস্তবায়নে সুমনার মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সুবিধাজনক সময়ে ২৩তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডের আদলে সুমনার মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হবে।

সুমনা জানান, এখন নতুন করে পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করেছেন। সংসার, চাকরি সামলে এ বয়সে পড়া মনে রাখতে পারবেন কি না, তা বুঝতে পারছেন না। আর তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ না চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিষয়ে পড়তে হবে, তা–ও তো জানা নেই।

সুমনা সরকার বলেন, ‘রায়ে আদালত বলেছেন ভাইভায় উত্তীর্ণ হলে আমার বয়স অনুযায়ী সিনিয়রিটি ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে। তবে আমি যেহেতু সরকারের কোনো কাজ করিনি, তাই রায়ে বেতন-ভাতা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। আক্ষেপ একটাই, পিএসসির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আমার ভোগান্তির জন্য কোনো দিন সরি বলা হয়নি। পিএসসির সাবেক এক কর্মকর্তা হুমকি দিয়েছিলেন, আমি মামলায় জিতলেও কীভাবে পরীক্ষা দিই, তা তিনি দেখে নেবেন। এই কর্মকর্তা এখন অবশ্য আর পিএসসিতে নেই।’

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

পিএসসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সুমনা সরকার মামলায় জিতেছেন। পিএসসি তাঁর মৌখিক পরীক্ষা নেবে। বর্তমানে ৪২তম বিসিএস পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা চলছে, দেশের করোনা পরিস্থিতি—সব মিলে সুমনা সরকারের বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এ বিষয়ে তাঁকে জানানো হয়েছে।

টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা অমল কৃষ্ণ সরকার স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আবদুল আহাদের সই করা সনদ, ২০০৩ সালের ২১ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদপত্র, মুক্তিবার্তার নম্বরসহ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সব সনদ প্রথম আলোর কাছে পাঠিয়েছেন সুমনা সরকার।

ফাইল ছবি

সুমনা সরকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার কাগজপত্র যদি ঠিক না–ই থাকে, তাহলে আমাকে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা পর্যন্ত কেন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো? আমি আশা করেছিলাম, বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করব। এত দিনে পিএসসি আমার ভাইভা পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিল। আমার সরকারি চাকরির অবসরের বয়স আছে আর মাত্র ১১ বছর। তারপরও আমি শেষটা দেখতে চাই।’

সুমনা সরকার বলেন, ‘বিসিএস পরীক্ষার পর আমার বড় ছেলের জন্ম হয়। তাই তখন আর রিট করার কথা চিন্তা করিনি। তবে সে সময় আরও অনেকে একসঙ্গে রিট করে সুবিচার পেয়েছিলেন। পরে একা একা আইনি লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিই। এ রায় পেতে পেতে আমার সেই বড় ছেলেই এখন মেডিকেলের প্রথম বর্ষে পড়ছে।’

মৌখিক পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছেন কি না, জানতে চাইলে সুমনা জানান, ২০১৪ সালে ডিপ্লোমা, ফেলোশিপ করলেও আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েছেন তো অনেক আগে। এখন আবার নতুন করে পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করেছেন। সংসার, চাকরি সামলে এ বয়সে পড়া মনে রাখতে পারবেন কি না, তা বুঝতে পারছেন না। আর তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ না চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিষয়ে পড়তে হবে, তা–ও তো জানা নেই।

সুমনা বললেন, ‘পিএসসি চাইলে তো আমাকে এমনিতেই নিয়োগ দিতে পারত। তবে আমি শেষটা দেখতে চাই। এ দীর্ঘ সংগ্রামে স্বামী পাশে ছিলেন, আমার পক্ষ হয়ে ঢাকায়, আদালতে গিয়েছেন। তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা। তিনি পাশে না থাকলে এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।’

এসএসসি, এইচএসসির পর প্রথমবারেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সুমনা। বৃত্তির টাকায় পড়াশোনা শেষ করেছেন। সুমনার বাবা এ হাসপাতাল থেকেই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। সুমনার দাদাও পাকিস্তান আমলের চিকিৎসক ছিলেন। সুমনা সরকার জানালেন, তাঁর স্বামী চিকিৎসক অধ্যাপক প্রবীর কুমার দাশসহ তাঁর এক ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, সুমনার ছোট বোন (দেশের বাইরে থাকেন), বড় বোনের এক মেয়েসহ পরিবারের অনেকেই চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে এসএসসি পড়ুয়া নিজের ছোট ছেলেকেও সুমনা চিকিৎসক বানাতে চান বলে জানালেন।

সুমনা সরকার আক্ষেপ করে বললেন, ‘পরিবারে ভাইবোনেরা বিসিএস দিয়ে কেউ চিকিৎসক বা কেউ অন্য পেশায় খুব ভালো অবস্থানে আছেন। বন্ধু-বান্ধবও আছে ভালো অবস্থানে। একসময় আমি বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। ২৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। তখন ছোট ছেলেটি ছোট ছিল। তাই আর পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে পারিনি। পরে তো বিসিএস দেওয়ার বয়সই পার হয়ে যায়। আমি সব সময় চেয়েছিলাম সরকারি চাকরি করতে। অথচ সে স্বপ্ন এখন পর্যন্ত পূরণ হলো না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মোতাহার হোসেন (সাজু) এবং তাঁর স্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সেলিনা আক্তার চৌধুরী সুমনা সরকারের রিট মামলা পরিচালনা করেন। এত বছর পর রিট মামলার রায় পাওয়া প্রসঙ্গে মো. মোতাহার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁর সন্তান কখনোই মাথা নত করেন না, এ রায় তারই প্রমাণ। সুমনা সরকারের বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে কোনো দুর্বলতা ছিল না বলেই তিনি মাথা উঁচু করে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। এ রায়ের ফলে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের অবিচারের শিকার হবেন না বা সুমনা অন্যদের কাছে উদাহরণ হিসেবে থাকবেন।

আইনজীবী মো. মোতাহার হোসেন সুমনা সরকারের এ ঘটনায় পিএসসির দায় আছে বলে উল্লেখ করে বলেন, পিএসসি সুমনা সরকারের বাবার ‘প্রভিশনাল সনদ’ দিয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে পারত। তা না করে পরীক্ষাটাই দিতে দেয়নি। সুমনা সরকারের সঙ্গে তখন যাঁরা বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। এখন পিএসসি সুমনা সরকারের সঙ্গে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করে কি না, তা–ই দেখার বিষয়।