নার্সিং কলেজের প্রশ্ন ফাঁস করতেন তাঁরা

প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় একটি নার্সিং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ৬ সদস্যকে গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় একটি নার্সিং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ছয় সদস্যকে গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, গত ১৯ মে ২০২২ তারিখে হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট ব্যবহার করে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সিন্ডিকেটের মূল হোতা ইকবাল ও তাঁর অন্যতম তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের ১ম বর্ষ ফাইনাল বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরীক্ষা শুরুর আগেই আদান–প্রদান করার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদল ২০ আগস্ট পরীক্ষা শুরুর আগে একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি ও সাদা কাগজে হাতে লেখা প্রশ্নপত্রের ছবি উদ্ধার করে। পরে র‍্যাব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রাতে র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১০–এর অভিযানে রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা ফরিদা খাতুন (৫১), মনোয়ারা খাতুন (৫২), নার্গিস পারভীন (৪৭), কোহিনুর বেগম (৬৫), ইসমাইল হোসেন (৩৮), আরিফুল ইসলামকে (৩৭) গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের কপি এবং ৯টি মুঠোফোন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বর্ণিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করেন।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সর্বমোট ৯৮টি নার্সিং কলেজের মধ্যে বর্তমানে ৩৮টি কলেজে পরীক্ষা চলমান। প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন প্রশ্ন প্রণয়নকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। যাঁরা দুই সেট আলাদা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে থাকেন। পরবর্তী সময় এসব প্রশ্নপত্রকে যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি মডারেটর টিম নিয়োগ করা হয়। যাদের কাজ হচ্ছে, প্রশ্নপত্রগুলো থেকে পরীক্ষার জন্য এক সেট পরিপূর্ণ প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেগুলো সিলগালার মাধ্যমে চিকিৎসা অনুষদের ডিনের কাছে জমা দেওয়া। পরবর্তী সময় চিকিৎসা অনুষদের ডিন বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রের প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য চার সদস্যদের একটি গোপনীয় টিম নিয়োগ করে থাকেন; যারা নির্বাচিত প্রশ্নপত্রটি প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে নিযুক্ত থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রশ্নপত্রগুলো প্রিন্ট করে আলাদা আলাদা প্যাকিং করে তার উপরে কেন্দ্রের নাম লিখে সিলগালা করে দেন। পরবর্তী সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই প্রশ্নপত্রগুলো বিভিন্ন কেন্দ্রে বিতরণ করে থাকেন।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে এই চক্রের মূল হোতা গ্রেপ্তারকৃত ফরিদা খাতুন। তিনি রাজধানী মহাখালীর একটি নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক। প্রায় ১০ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ের দায়িত্বে থাকেন। চক্রের অপর সদস্য গ্রেপ্তারকৃত নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম তাঁর অন্যতম সহযোগী। তাঁরা পরস্পর যোগসাজশে বেশ কিছুদিন ধরে শিক্ষকতার আড়ালে ওই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন।

গ্রেপ্তারকৃত ফরিদা খাতুন ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিতব্য বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় চিকিৎসা অনুষদের ডিন কর্তৃক নির্বাচিত চার সদস্যদের গোপনীয় টিমের একজন সদস্য ছিলেন। ১৩ আগস্ট নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম ফরিদা খাতুনের কাছে কম্প্রেহেনসিভ নার্সিং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চাইলে ফরিদা খাতুন প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ের সময় সংগ্রহ করে রাখা প্রশ্নপত্র গ্রেপ্তারকৃত নার্গিস ও গ্রেপ্তারকৃত মনোয়ারা বেগম প্রদান করেন। পরবর্তী সময় তাদের এই চক্রের আরেক সদস্য প্রশ্নপত্রটি গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইলের মাধ্যমে কোহিনুর বেগমের কাছে প্রদান করে। এ সময় ইসমাইল কিছু কপি নিজের কাছে রেখে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে সরবরাহ করে। পরবর্তী সময় কোহিনুর বেগম ও আরিফ প্রশ্নপত্রটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেন।

ফরিদা, মনোয়ারা, নার্গিস প্রায় ১০ বছর ধরে একটি নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তাঁরা বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন কর্তৃক নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে নিযুক্ত গোপন টিমের সদস্য ছিলেন। গ্রেপ্তারকৃত কোহিনুর বেগম ২০০৮ সাল থেকে ঢাকার একটি সরকারি নার্সিং কলেজে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দেন।

গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল হোসেন রাজধানীর একটি নার্সিং কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত এবং গ্রেপ্তারকৃত আরিফ ঢাকার একটি নার্সিং কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তারা ২০ আগস্ট ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রশ্নপত্রটি ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য কোহিনুরের থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করে। গ্রেপ্তারকৃত আরিফ ২০১৭ সালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অপরাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন।