বিসিএস কথন পর্ব-২
বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা
বর্তমানে চাকরিপ্রার্থীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। সিভিল সার্ভিসের সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত-২ ক্যাটাগরিতে মোট ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। প্রতিটি ক্যাডারের দায়িত্ব ও কাজ, পদায়ন ও প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করা হচ্ছে চাকরি-বাকরি পাতায়। আজ দ্বিতীয় পর্বে থাকছে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ৩৫তম বিসিএসের কর্মকর্তা রবিউল আলম লুইপা
বিসিএস পুলিশ ক্যাডার
বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার চাকরিপ্রার্থীদের কাছে অন্যতম পছন্দের ক্যাডার। কেউ এটিকে পছন্দক্রমের শীর্ষে, কেউবা দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে রাখেন। পছন্দক্রমের যেখানেই রাখুন না কেন, বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অথবা বিপদ-আপদের প্রয়োজনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী এই সংস্থা সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকা প্রয়োজন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিসহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
দায়িত্ব ও কাজ
চাকরির শুরুতে পুলিশ ক্যাডারের পদের নাম সহকারী পুলিশ সুপার। এরপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি, অতিরিক্ত আইজিপি ও আইজিপি পর্যন্ত হওয়া যায়। তবে মেট্রোপলিটন এলাকায় পদায়ন হলে পদের নাম হয় সহকারী পুলিশ কমিশনার। এরপর ধাপে ধাপে অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, উপপুলিশ কমিশনার, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ কমিশনার (অতিরিক্ত আইজিপি/ডিআইজি পদমর্যাদা) পদে পদোন্নতি হয়।
পুলিশ ক্যাডারের এক কর্মকর্তাকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে যোগদান করতে হয়। একই দিনে তাঁকে মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ন্যস্ত করা হয়। ফাউন্ডেশন ও বেসিক ট্রেনিংয়ের পর একজন শিক্ষানবিশ এএসপিকে যেকোনো একটি জেলা পুলিশ থানায় দুই মাস, সার্কেলে এক মাস ও অন্যান্য জেলা পুলিশ কার্যালয়ে বিভিন্ন মেয়াদেসহ মোট ছয় মাস সংযুক্ত রেখে হাতে-কলমে সব কার্যক্রম দেখানো হয়। এরপর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে (যেমন ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চ—ডিবি, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট—সিআইডি ইত্যাদি) পদায়ন করা হয়। মেট্রোপলিটন পুলিশে পদায়ন পেলে পদের নাম হবে সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি)।
চাকরির তিন বছর পর এএসপিদের পর্যায়ক্রমে সার্কেলে পদায়ন শুরু হয় (কয়েকটি থানা মিলে একটি সার্কেল)।
সার্কেলের অপরাধ দমন ও আইন বাস্তবায়ন, অধীনস্থ বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যের কাজ তদারকি, প্রশাসনিক প্রটোকল ইত্যাদি সার্কেল এএসপির মূল কাজ।
প্রমোশনের পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রেড-৬) হিসেবে প্রথমে সার্কেল অফিসে (জেলার বড় ও পুরোনো সার্কেল) দায়িত্ব পালন করেন এবং ২-৩ বছর পর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অপরাধ/তদন্ত/প্রশাসন প্রভৃতি বিভাগে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জেলা পুলিশ সুপারের কাজে সহায়তা করতে হয়।
পুলিশ ক্যাডারের গ্রেড-৫ কর্মকর্তার পদ পুলিশ সুপার। আমরা অনেকেই ভুল করে পুলিশ সুপার পদটিকে জেলা পুলিশ সুপার মনে করি। একটি জেলায় কয়েকজন পুলিশ সুপার থাকেন। এর মধ্যে একজন জেলা পুলিশ সুপার। অন্যরা ইন-হাউস ট্রেনিং সেন্টার, পিবিআই, হাইওয়ে পুলিশ ইত্যাদি বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সরকারি বেতন স্কেল-২০১৫ অনুসারে সব ক্যাডারের কর্মকর্তা ২২,০০০ টাকা মূল বেতনে চাকরিজীবন শুরু করেন। যোগদানের সময় একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পর মূল বেতন হয় ২৩,১০০ টাকা। এ ছাড়া মূল বেতনের নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া (জেলা শহরে ৪০ শতাংশ, অন্যান্য বিভাগে ৪৫ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ৫০ শতাংশ), ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, সন্তানের জন্য শিক্ষাসহায়ক ভাতা, ঈদ/পূজায় উৎসব ভাতা, বৈশাখে নববর্ষ ভাতা, সরকারি দায়িত্ব ও যাতায়াতের জন্য টিএ/ডিএ ভাতাসহ সরকারি সব আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
অতিরিক্ত ডিআইজি (গ্রেড-৪) এবং ডিআইজি (গ্রেড-৩) রেঞ্জ পুলিশের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাটালিয়ন পুলিশে (যেমন র্যাব, এপিবিএন, এসপিবিএন) ইউনিটপ্রধান হিসেবে অতিরিক্ত ডিআইজি/ডিআইজি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আইজিপি) দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
অতিরিক্ত আইজিপিরা হেডকোয়ার্টার এবং বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্বে থাকেন। বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পুলিশ মহাপরিদর্শক বা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি)।
প্রশিক্ষণ
যোগদানের পর পুলিশ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রে (বিপিএটিসি) ছয় মাস মেয়াদি বনিয়াদি প্রশিক্ষণ (ফাউন্ডেশন ট্রেনিং—এফটিসি) সম্পন্ন করেন। বনিয়াদি প্রশিক্ষণের পর রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ইন পুলিশ সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া সাভারে ৫২ দিন মেয়াদি ল্যান্ড সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট ট্রেনিং, ক্যান্টনমেন্টে ৪২ দিনব্যাপী মিলিটারি ওরিয়েন্টেশন কোর্স, সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে হেলিকপ্টারে সামরিক প্রশিক্ষণ, যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআই গ্র্যাজুয়েশন, নর্থ ক্যারোলাইনার ব্ল্যাক ওয়াটার ট্রেনিং একাডেমির কমান্ডো ট্রেনিংসহ দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হতে পারে।
বেতন ও ভাতা
সরকারি বেতন স্কেল-২০১৫ অনুসারে সব ক্যাডারের কর্মকর্তা ২২,০০০ টাকা মূল বেতনে চাকরিজীবন শুরু করেন। যোগদানের সময় একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পর মূল বেতন হয় ২৩,১০০ টাকা। এ ছাড়া মূল বেতনের নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া (জেলা শহরে ৪০ শতাংশ, অন্যান্য বিভাগে ৪৫ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ৫০ শতাংশ), ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, সন্তানের জন্য শিক্ষাসহায়ক ভাতা, ঈদ/পূজায় উৎসব ভাতা, বৈশাখে নববর্ষ ভাতা, সরকারি দায়িত্ব ও যাতায়াতের জন্য টিএ/ডিএ ভাতাসহ সরকারি সব আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
পুলিশ সার্ভিসে হরতাল অবরোধ প্রভৃতি ডিউটির জন্য জেলা শহরে ও ঢাকায় দৈনিক ভাতা, র৵াবে চাকরিকালীন ভাতাসহ দায়িত্ব ভেদে বিভিন্ন ধরনের ভাতা পাওয়া যায়। ৪ সদস্যের পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় রেশন সুবিধা, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের সমৃদ্ধ এবং আন্তরিক সেবা, চাকরিজীবনে মিশন থেকে একটি বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা এই ক্যাডারের বিশেষ প্রাপ্তি।
সুযোগ-সুবিধা
সার্কেলের দায়িত্ব পালনকালে ডাবল কেবিন পিকআপ, মুঠোফোন বিল, কোয়ার্টার আর গানম্যান পুলিশ সার্ভিসের প্রফেশনাল কাজকে সহজ করে। প্রশাসন ক্যাডারের মতো পুলিশ ক্যাডারেও কাজের বৈচিত্র্য আছে। পুলিশিং ভালো না লাগলে আপনি ট্রেনিং একাডেমিতে শিক্ষকতা করতে পারবেন, ইউনিফর্ম ভালো না লাগলে সাদা পোশাকে সিআইডিতে কাজ করতে পারবেন, গবেষণা থেকে আইটি, পুলিশ হাসপাতালের দায়িত্ব থেকে বোম্ব ডিসপোজাল ডিউটি, ডেস্ক জব থেকে রোড ডিউটি—সবকিছুর ফ্লেভার পাবেন পুলিশ সার্ভিসে। এপিবিএন, সোয়াট, র৵াবে, ইউএন মিশন প্রতিটি ইউনিটের আলাদা আলাদা পোশাক আপনার রুচির ভিন্নতা এনে দেবে।
পুলিশ ক্যাডারে নিজ জেলায় পদায়ন করা হয় না। তবে নিজ জেলার আশপাশের জেলায় পদায়ন করা হতে পারে।
এ ক্যাডারে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা ডিউটি বলে কিছু নেই। রাতে ঘুম থেকে উঠে দুর্ঘটনাস্থলে যেতে হবে। সমাজের অন্ধকার দিক—ডাকাতি, হত্যা, ফাঁসি ইত্যাদি নিয়েই থাকতে হতে পারে। ঈদে অন্যরা যখন বাড়িতে যাবে, আপনি হয়তো তখন রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকবেন। তাই চাকরিক্ষেত্রে প্রচুর শারীরিক, মানসিক পরিশ্রম ও রাজনৈতিক চাপ সামলানোর মানসিকতা থাকতে হবে।