চাকরিতে কাজের ধরন যেভাবে বদলে দেবে দাবদাহ

প্রচণ্ড দাবদাহে কাজে বেরিয়ে রাস্তার পাশে পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন এই নারী। পালেরমো, ইতালি, ১৯ জুলাই।
ছবি: রয়টার্স

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে দাবদাহ বাড়ছে। দাবদাহের জেরে তাপমাত্রার পারদ ভাঙছে রেকর্ড। চলমান তাপপ্রবাহে নাকাল ইউরোপের জীবন। একই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলেও। চলতি মাসের শুরুতে ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম দিন রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই সবচেয়ে উষ্ণ মাস হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট থমাস স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন পি আব্রাহাম বলেছেন, পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এই উষ্ণ আবহাওয়ায় দীর্ঘ সময়ের জন্য ‘আটকে’ যাচ্ছে। আগে এমন তাপপ্রবাহ এক থেকে দুই দিন থাকত; কিন্তু তা এখন তিন থেকে টানা পাঁচ দিন স্থায়ী হচ্ছে। যাঁরা এই দাবদাহে টানা এক থেকে দুই দিন কাজ করছেন, তাঁদের দীর্ঘ মেয়াদে নানা সমস্যা হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে এবং এই অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ স্বাভাবিক হবে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ধরনও পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের কাজ করার পদ্ধতিও পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাই কর্মীদের জানতে হবে, এতে তাঁরা কী ধরনের সমস্যায় পড়বেন। আর কর্মীদের রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও চেষ্টা করতে হবে।

অফিস ও অফিসের বাইরের কাজ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাবদাহের জেরে কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন সাধারণত দুটি বিভাগে বিভক্ত হবে। এর প্রথমটি হলো অফিসের বাইরের কাজ, যেখানকার পরিবেশ বেশ গরম। যেমন কৃষি বা উৎপাদন খাত, যেখানে উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।
২০২২ সালে মাদ্রিদে একজন সড়ক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর প্রচণ্ড দাবদাহে কাজ করার পর হিটস্ট্রোকে মৃত্যু হয়। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, কর্মীদের সুরক্ষার জন্য এ ধরনের কাজের পরিবেশে সম্ভবত কিছু বড় পরিবর্তন ঘটবে।

চলমান তাপপ্রবাহে নাকাল জনজীবন। ভ্যাটিকান, ইতালি, ১৯ জুলাই।
ছবি: রয়টার্স

আব্রাহাম বলেছেন, ‘গরমে বাইরে কাজ করার জন্য অতিরিক্ত বিরতিসহ ছোট ছোট শিফটের প্রয়োজন হবে। আর রাতে বেশি কাজ করতে হবে।’ তাপবিজ্ঞানের ওই অধ্যাপক বলেন, সন্ধ্যার পর শিফটে কর্মঘণ্টা শুরু করা কোনো সমাধান নয়। এতেও ঝুঁকি থেকে যাবে। প্রথমত, রাতের তাপমাত্রা দিনের তুলনায় দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘যদি কর্মীরা দিনে কর্মক্ষেত্রে গরমের মধ্যে কাজ করেন আর রাতের তাপমাত্রা অনেক গরম হয়, এ পরিস্থিতে তাঁদের শরীর ঠান্ডা হতে পারে না। এতে পরের দিন তাঁদের অনেক কঠিন সময় পার করতে হবে।’ এতে তাঁদের দৃষ্টিশক্তির সমস্যাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সমস্যার সৃষ্টি হবে।

আব্রাহামের ধারণা, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কুলিং সেন্টারগুলো আরও সাধারণ হয়ে উঠবে। আর কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে এনে আবারও কাজ করানোর জন্য তাঁদের বিরতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে নিয়োগকর্তাদের।

যেসব কর্মী অফিসের ভেতর বা শীতল পরিবেশে কাজ করেন, তাঁরা চরম তাপমাত্রার সংস্পর্শ থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। তবে তাঁদের কাজের সময়সূচিতেও পরিবর্তন আসা উচিত।

প্রচণ্ড গরমে কপাল-গলায় ঠান্ডা পট্টি ও ছাতা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন এই নারী। বেইজিং, চীন, ২৩ জুন।
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্যের টেসাইড ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্কুলের সাসটেইনেবলিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, লিডারশিপ, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্সেস বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মনসুর সুমরো বলেন, ‘রিমোট কাজ (হোম অফিস), হাইব্রিড কাজ (সপ্তাহে এক দিন সশরীর অফিস ও অন্য দিন হোম অফিস), সপ্তাহে চার দিন অফিসের মতো সমসাময়িক কাজের ব্যবস্থা...এবং সপ্তাহে আট ঘণ্টার পরিবর্তে ছয় ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা তাপপ্রবাহের পরিস্থিতিতে সহায়ক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এ ছাড়া হোম অফিসে অনানুষ্ঠানিকভাবে পোশাক পরার কারণে কর্মীরা আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন।’

মনসুর সুমরো বলছেন, দুই পরিবেশেই কিছু কর্মীর অফিসের সময়সূচি ইতিমধ্যেই পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। তাঁদের কাজ অনেক সকালে শুরু হচ্ছে এবং মধ্যাহ্নের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আগে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমন কিছু সম্ভবত আরও দেখা যাবে।

নিয়োগকর্তাদের ভূমিকা

নিয়োগকর্তারা তাঁদের কর্মীদের জন্য নতুন ব্যবস্থাও প্রবর্তন করতে পারেন। মনসুর সুমরো বলেন, কিছু নিয়োগকর্তা বয়স্ক কর্মী, অন্তঃসত্ত্বা, শারীরিক প্রতিবন্ধী কর্মীসহ দাবদাহে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মীদের চিহ্নিত করতে পর্যায়ক্রমে তাপঝুঁকির মূল্যায়ন করছেন।

মনসুর সুমরো আরও বলেন, এই কর্মীদের প্রয়োজনে ভাতা ও অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় নিয়োগকর্তারা এই পর্যবেক্ষণগুলো আরও করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

তাপপ্রবাহের কারণে অফিসের দেয়ালের কাচ পরিষ্কার করছেন কর্মীরা। বেইজিং, চীন, ২২ জুন।
ছবি: রয়টার্স

একইভাবে মনসুর সুমরো পূর্বাভাস দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে নির্দিষ্ট তাপ–সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ও কর্মীদের সুস্থতার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে। এর মধ্যে তাপ-চাপ ব্যবস্থাপনা বা পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে কর্মীদের সাহায্য করার জন্য ফিটনেস ও পুষ্টিবিষয়ক পরিকল্পনার প্রশিক্ষণ কর্মশালা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
মনসুর সুমরো আরও বলেন, ‘অবকাঠামো বিনিয়োগও গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাপপ্রতিরোধী কাজের পরিবেশ তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে উন্নত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাসহ টেকসই  অবকাঠামো অন্তর্ভুক্ত আছে।’

মনসুর সুমরো বলেন, ‘তাপ–সম্পর্কিত অস্বস্তি কাজের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। একইভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোও যতটা সম্ভব তাপ–সম্পর্কিত স্বাস্থ্য পরিস্থিতির নেতিবাচক দিক এড়াতে চায়। কারণ, কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়লে অফিসে অনুপস্থিত থাকেন, এতে তাঁদের বেতন কাটা যায়। এ কারণে তাঁদের পারিবারিক জীবন প্রভাবিত হতে পারে। আর নিয়োগকর্তাদের এ জন্য চিকিৎসায় ব্যয় করতে হয়, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং আইনি বিবাদের পরিণতি ভোগ করতে হয়।’

যদিও কর্মীদের রক্ষা করার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর বোঝা বাড়ছে; এ ক্ষেত্রে আইন অবশ্যই দ্রুত একটি ভূমিকা পালন করবে বলে একমত পোষণ করেছেন আব্রাহাম ও সুমরো।

হোম অফিস, সপ্তাহে চার দিন অফিস বা আট ঘণ্টার পরিবর্তে ছয় ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা তাপপ্রবাহের পরিস্থিতিতে সহায়ক বলে প্রমাণিত হচ্ছে।

তবে একটি ভালো খবর হলো, কোনো কোনো সরকার ইতিমধ্যেই এই বাড়তে থাকা তাপ্রবাহের যুগে কাজ করার জন্য আইন প্রণয়ন করছে। স্পেনে এপ্রিল মাসকে দেশের উষ্ণতম মাস রেকর্ড করা হয়েছে। দেশটির সরকার মালিক ও শ্রমিক উভয়ের জন্য নতুন আইন ঘোষণা করেছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, যখন আবহাওয়ার অবস্থা কমলা (উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি) বা লাল (চরম ঝুঁকি) হয়ে যায়, তখন নির্ধারিত কর্মদিবসের সময় হ্রাস বা পরিবর্তনসহ নিয়োগকর্তাদের কাজের অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক।

তবে বিষয়টি জরুরি হলেও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ দেশ এ বিষয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে অপ্রস্তুত।

চলতি জুলাইয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে শীতল করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের সম্মিলিত বিদ্যুৎ ক্ষমতার সমতুল্য হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো মধ্যে আছে আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ড।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং কাজের পরবর্তী ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণ আবহাওয়া নিঃসন্দেহে কাজের ধরনকে বদলে দেবে।