মানুষের আয়ু বাড়ছে, চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়বে কি

বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬০ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসর নেওয়াটা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় নাফাইল ছবি: রয়টার্স

সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ও। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময়সীমা পুনর্বিবেচনা করার আলোচনা চলছে।

বলা হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬০ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসর নেওয়াটা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। অনেকেই বলছেন, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার বয়স ৬৫ করা উচিত।

গত মার্চে বিনিয়োগ-ব্যবস্থাপনা সংস্থা ব্ল্যাকরক তাদের বিনিয়োগকারীদের কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও ল্যারি ফিঙ্ক তাঁদের ৬০ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার প্রত্যাশী কর্মীদের জন্য একটি সতর্কবাণী দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা জাল ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ফিঙ্ক সতর্ক করে বলেন, ৬৫ বছর বয়সে অবসর নেওয়া অনেকের জন্য, এমনকি অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সম্ভব হবে না।

ল্যারি ফিঙ্ক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘৩০ বছর আগের তুলনায় এটি (অবসর) অনেক কঠিন প্রস্তাব; এবং এটি এখন থেকে ৩০ বছর পরে আরও অনেক কঠিন প্রস্তাব হবে।’

২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মানুষের সম্ভাব্য আয়ু ৬৭ বছর থেকে বেড়ে ৭৩–এ দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের ধারণা, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজনের বয়স ৬৫ বা এর বেশি হবে। জনসংখ্যার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশ এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেখানে নতুন কর্মসংস্থানের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ কর্মশক্তি ছেড়ে যাবে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য ২০২৯ সালের মধ্যে, ব্রাজিল ২০৩৫ সালের মধ্যে, ভারতে ২০৪৮ সালের মধ্যে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০৫৩ সালের মধ্যে ওই পর্যায়ে পৌঁছাবে।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য বিষয়ের অধ্যাপক রেবেকা সিয়ার বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্যে ১৮৫০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে আয়ু বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তবে অবসরের বয়স এতটা পরিবর্তন হয়নি।’

স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক অবস্থা দুটোই নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তাহলে ৬৫ বছর বয়সে অবসর নেওয়া এই আধুনিক বিশ্বে কি অবাস্তব লক্ষ্য?

বোস্টন কলেজের সেন্টার ফর রিটায়ারমেন্ট রিসার্চের সিনিয়র রিসার্চ ইকোনমিস্ট গ্যাল ওয়েটস্টেইন বলেছেন, ‘আধুনিক পরিস্থিতির সঙ্গে অবসর গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করা হয়নি। তবে এটিও অস্পষ্ট যে কেন ৬৫ বছর বয়সকে অবসর গ্রহণের নির্ধারণ করা হচ্ছে।’

তবে অনেক সরকারি প্রকল্প এটিকে একটি মান হিসেবে ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল স্বাস্থ্যসেবা বিমা প্রোগ্রাম মেডিকেয়ারে বর্তমানে শুধু ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের জন্য (অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ব্যতিক্রম আছে) বিমার সুবিধা আছে। আমেরিকানরা ৬৭ বছর বয়সে তাঁদের সম্পূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা–সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেন। আর একই বয়সে যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা তাঁদের সর্বজনীন রাষ্ট্রীয় পেনশন দাবি করতে পারেন।

যুক্তরাজ্যে পেনশনের বয়স ২০২৬ সালের মে থেকে ২০২৮ সালের মার্চের মধ্যে ৬৬ থেকে ৬৭ বছরে উন্নীত হবে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন এই নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তখন আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। যুক্তরাজ্যে পুরুষদের আয়ু ছিল প্রায় ৬৬ বছর ও নারীদের ছিল ৭১ বছর। কার্ডিফ মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্সের প্রধান লেকচারার ক্রিস প্যারি বলেছেন, ‘আমাদের জীবন দীর্ঘতর হচ্ছে, আমরা মধ্য বয়সের শেষের দিকে এবং প্রারম্ভিক বয়স্কদের মধ্যে সুস্থ থাকছি। এখন এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা তাঁদের ৮০ বছরের বয়সের শুরু বা মাঝামাঝি সময়ে সুস্থ আছেন এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব সক্রিয় জীবন উপভোগ করেন।’

৮০ ও ৯০ বছর বয়সী নাগরিকদের জন্য সরকারি ভাতা দেওয়ার নীতি নেই। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও এই নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতির এই অর্থনীতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব মানুষ আর সঞ্চয় ধরে রাখতেও পারছেন না।

এ ছাড়া একসময় চাকরি করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ যে সম্পদ করেন, পরবর্তী জীবনে তা আর তাঁর নিজের থাকে না। অধ্যাপক রেবেকা সিয়ার বলেছেন, ‘সম্পদ মূলত বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়, দাদা-দাদি থেকে মা–বাবা থেকে তা সন্তানদের কাছে যায়। আমরা বংশপরম্পরায় সম্পদ বদল করি। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, আমাদের কাছে সম্পদের প্রবাহ এখন মা–বাবা থেকে দাদা-দাদি প্রজন্মের কাছে যাচ্ছে।’

জাতিসংঘের ধারণা, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজনের বয়স ৬৫ বা এর বেশি হবে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ঐতিহ্যগত নিরাপত্তার অভাবে সারা বিশ্বে অনেক কর্মীকে চাকরিতে ৬৫ বছরের বেশি বয়স পর্যন্ত থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমেরিকান বিমা কোম্পানি নর্থওয়েস্টার্ন মিউচ্যুয়ালের ২০২৩ সালের জুন মাসের তথ্যে দেখা গেছে, মার্কিন কর্মীরা বিশ্বাস করেন অবসরকালীন সঞ্চয়ের জন্য ‘ম্যাজিক নম্বর’ প্রায় ১৩ লাখ ডলার মূল্যের সম্পদ, যা অধিকাংশ মানুষ তাঁদের ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ে সঞ্চয় করতে পারে না।

আধুনিক সময়ে অল্প বয়সে কাজ শুরু করতে হবে এবং বয়স ৬৫ বছর পেরিয়ে গেলেও কাজ করতে হবে। কিছু কিছু সরকার অবশ্যই অবসরের জন্য ইতিমধ্যেই ৬৫ বছরকেও পুরোনো হিসেবে বিবেচনা করছে। যুক্তরাজ্যে পেনশনের বয়স ২০২৬ সালের মে থেকে ২০২৮ সালের মার্চের মধ্যে ৬৬ থেকে ৬৭ বছরে উন্নীত হবে। ২০৪৪ সালের পরে এই বয়সসীমা ৬৮ বছরে দাঁড়াতে পারে।