চার দিন কর্মসপ্তাহের চাকরিতে আগ্রহ বাড়ছে যুক্তরাজ্যে: ছয় বছরে যুক্ত দুই লাখ
কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে যুক্তরাজ্যে চার দিনের কর্মসপ্তাহের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। দেশটির ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস অফিসের (ওএনএস) সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের পর থেকে দুই লাখের বেশি কর্মী এ ধরনের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, যেখানে সপ্তাহে চার দিন কাজ করতে হয়।
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা চার দিন পূর্ণ সময়ে কাজ করেন। ২০১৯ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ চার দিনে পূর্ণ সময় কাজ করা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখের বেশি।
এ ছাড়া একই সময়ে এক লাখ আংশিক সময়ের কর্মী চার দিন কর্মসপ্তাহের কাজে যুক্ত হয়েছেন। পূর্ণ সময় ও আংশিক সময়ের কর্মী মিলিয়ে এখন যুক্তরাজ্যে চার দিনে কাজ করা মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে। ২০১৯ সালের শেষ তিন মাসে যা ছিল মোট কর্মীর ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, তা বেড়ে ২০২৪ সালের একই সময়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশে। তবে এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট নয়, কর্মীরা চার দিনে আগের মতো সমান সময় কাজ করছেন কি না, নাকি তাঁরা সময় কমিয়ে বেতনও কম নিচ্ছেন।
৩২ ঘণ্টার কর্মসপ্তাহের দাবি
চার দিন কর্মসপ্তাহের পক্ষে থাকা সংগঠনগুলো বলছে, এটি কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে এবং কর্মীদের বেশি অনুপ্রাণিত করে। এতে নিয়োগ ও কর্মী ধরে রাখার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানগুলোর সুবিধা হয়।
‘ফোর ডে উইক ফাউন্ডেশন’ জানিয়েছে, মহামারির পর থেকে ৪২০টির বেশি প্রতিষ্ঠান চার দিন কর্মসপ্তাহ চালু করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ১২ হাজারের বেশি কর্মী। এ তথ্য এসেছে সংস্থাটির নিয়োগকর্তা স্বীকৃতি কর্মসূচিতে সই করা প্রতিষ্ঠান এবং যারা প্রকাশ্যে তাদের নীতির ঘোষণা দিয়েছে তাদের হিসাব থেকে।
সংগঠনটি দাবি করছে, ৩২ ঘণ্টার চার দিন কর্মসপ্তাহ যেন যুক্তরাজ্যে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয় এবং কর্মীদের বেতন কমানো ছাড়াই তা বাস্তবায়ন করা হয়। ফোর ডে উইক ফাউন্ডেশনের ব্যবসা নেটওয়ার্ক সমন্বয়কারী স্যাম হান্ট বলেন, ‘৯টা থেকে ৫টা, ৫ দিনের কর্মসপ্তাহ ১০০ বছরের পুরোনো মডেল। এটি আর আমাদের জীবনযাত্রা ও কাজের ধরনের সঙ্গে খাপ খায় না। অনেক আগেই এর হালনাগাদ প্রয়োজন ছিল। চার দিনের কর্মসপ্তাহ কোনো বেতন কমানো ছাড়াই মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, যেখানে মানুষ আরও সুখী, সুস্থ ও পরিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে।’
গবেষণায় দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত মার্কেটিং, প্রযুক্তি খাত ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো চার দিন কর্মসপ্তাহ গ্রহণে সবচেয়ে এগিয়ে।
সরকারি খাতের ভূমিকা
কোভিড মহামারির পর যুক্তরাজ্যের কর্মসংস্কৃতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। ওএনএসের তথ্য অনুযায়ী, এখনো কর্মরত প্রাপ্তবয়স্কদের এক-চতুর্থাংশের বেশি হাইব্রিড কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করছেন। তবে অফিসে ফেরার বাধ্যবাধকতা নিয়ে টানাপোড়েন চললেও চার দিনের কর্মসপ্তাহে যাওয়ার পথ তুলনামূলক ধীর।
সাউথ কেমব্রিজশায়ার জেলা কাউন্সিল যুক্তরাজ্যে প্রথম স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্থায়ীভাবে চার দিন কর্মসপ্তাহ চালু করেছে। ২৭ মাসের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন কাউন্সিলের ৭০০ কর্মী স্বেচ্ছায় এ কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারেন। তাদের ৮০ শতাংশ সময়ের মধ্যে ১০০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে হয়, তবে বেতনে কোনো কাটছাঁট করা হয়নি।
পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে কাউন্সিল উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
–দ্রুত পরিকল্পনা অনুমোদন, বাসা মেরামত ও ভাতা প্রক্রিয়াকরণ।
–কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি এবং পদত্যাগের হার কমে যাওয়া।
–ব্যয়বহুল অস্থায়ী কর্মীর বদলে স্থায়ী নিয়োগ দিয়ে প্রায় ৪ লাখ পাউন্ড সাশ্রয়।
এখন আরও কয়েকটি কাউন্সিল চার দিন কর্মসপ্তাহের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
আগের কনজারভেটিভ সরকার এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল। তারা জানিয়েছিল, এ পদ্ধতি স্থানীয় করদাতাদের অর্থের সঠিক মূল্য দেয় না। ফলে তারা এ ধরনের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিল। তবে নভেম্বর ২০২৪-এ ক্ষমতায় আসার পর লেবার সরকার নির্দেশনা প্রত্যাহার করে জানায়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হলো ‘স্বাধীন নিয়োগকর্তা’, যারা তাদের নিজস্ব কর্মী ব্যবস্থাপনার নীতি নির্ধারণের অধিকার রাখে। ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রেনারসহ (কয়েক দিন আগে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে) লেবার পার্টির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা এ ধারণার প্রতি সমর্থন জানালেও দলটি এখনো এটি জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেনি।
স্কটল্যান্ডে পরীক্ষামূলক কর্মসূচি
২০২৪ সালের শুরুতে স্কটিশ সরকার চার দিন কর্মসপ্তাহের এক বছরের পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করেছে। এতে দুটি সরকারি সংস্থা অংশ নিচ্ছে। এ কার্যক্রমের ফলাফল চলতি বছরের শেষ দিকে প্রকাশ করা হবে।
চার দিন কর্মসপ্তাহে সাফল্যের ইতিবাচক প্রমাণ ক্রমেই বাড়ছে। এতে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা উন্নত হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারির পর এটাই যুক্তরাজ্যের কর্মসংস্কৃতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার এক বড় সুযোগ, যা আগামী কয়েক বছরে লাখ লাখ কর্মীর কর্মজীবনে প্রভাব ফেলতে পারে।