পরিবর্তনশীল চাকরির বাজারেও তরুণদের ভালো করার উপায়
বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থানের চিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যাঁরা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করেছেন বা কর্মজীবনের একেবারেই প্রবেশমুখে রয়েছেন, তাঁরা প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছেন। এই তীব্র প্রতিযোগিতা একদিকে অনেকের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ, কারও কারও ক্ষেত্রে সম্ভবনারও। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন জরিপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তরুণেরা অন্য সব বয়সী মানুষের তুলনায় নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি নৈরাশ্যবাদী। এর অন্যতম কারণ হলো প্রবল প্রতিযোগিতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা চাকরির প্রকৃতি বদলে যাওয়া এবং আগের মতো নিশ্চিত ‘ডিগ্রি পেলেই চাকরি’—এই সাধারণ সমীকরণ কাজ না করা।
তরুণদের হতাশার কারণ
লিংকডইনের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালের পর থেকে এন্ট্রি-লেভেল বা প্রাথমিক চাকরি বা চাকরি শুরুর বিজ্ঞাপন ৩৫ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। নতুন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য এটা প্রথম ধাক্কা। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই শত শত সিভি পাঠিয়েও কেবল প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। এ কারণে অনেককে বলা হচ্ছে ‘rejection generation’ বা প্রত্যাখ্যাত প্রজন্ম। ফলে তাঁরা মনে করছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ হয়তো আগের প্রজন্মের তুলনায় বেশি অনিশ্চিত।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: হুমকি নাকি সুযোগ?
এআইয়ের প্রসার এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। জরিপে অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ৬৩ শতাংশ করপোরেট নির্বাহী মনে করেন, এন্ট্রি-লেভেল কর্মীদের অনেক কাজ ভবিষ্যতে এআই দিয়ে করা সম্ভব হবে। এর ফলে নতুন নিয়োগের প্রয়োজন কমতে পারে। একই সঙ্গে, প্রায় ৪১ শতাংশ পেশাজীবী স্বীকার করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত পরিবর্তন তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এআই কাজ কেড়ে নিচ্ছে এটা সর্বাগ্রে সত্য নয়; বরং কাজের ধরন বদলে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের ৯৬ শতাংশ কাজ এআই দ্বারা সম্পাদনযোগ্য। এর মানে চাকরিটি হারিয়ে যাবে না; বরং সেই পেশার সংজ্ঞা নতুন আকারে গড়ে উঠবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কম্পিউটার সায়েন্স ডিগ্রির পাশাপাশি আপনার কাছে কি নৈতিকতা ও মানবিক প্রভাব বোঝার মতো জ্ঞান আছে? কারণ, কোম্পানিগুলো কেবল টেকনিক্যাল দক্ষতা নয়, নৈতিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাকেও গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।
ডিগ্রি বনাম দক্ষতা
আগের যুগে একটি ডিগ্রি অনেক সময়েই চাকরির নিশ্চয়তা দিত। কিন্তু আজকের দিনে কেবল ‘ডিগ্রি আছে’ বলা যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে বলতে হবে, সেই ডিগ্রি আপনার জন্য কী অর্থ বহন করে এবং কীভাবে তা বাস্তবে নানা সমস্যার সমাধানে কাজে লাগানো যায়। উদাহরণস্বরূপ, খুচরা ব্যবসা বা রিটেইল খাতে চাকরিগুলো আগে তেমন মূল্যায়িত হতো না, কিন্তু এখন নিয়োগকর্তারা দেখছেন, সেখানে কাজ করা তরুণেরা সাধারণত বেশি ‘সহনশীল ও অভিযোজনক্ষম’ হয়ে ওঠেন। এ ধরনের দক্ষতাই ভবিষ্যতের কর্মজীবনে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হতে পারে।
ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের ছবি
বিশ্লেষকদের মতে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বর্তমান চাকরিগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশের ধরন বদলে যাবে। অর্থাৎ একই চাকরিতে থাকলেও কাজের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। সেই সঙ্গে এমন নতুন চাকরির জন্ম হবে, যা আগে কেউ কল্পনাও করেনি। ১০ বছর আগে ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ কিংবা ২০ বছর আগে ‘ডেটা সায়েন্টিস্ট’ নামে কোনো চাকরি ছিল না। আজ এগুলো লাখো মানুষের আয়ের উৎস। ঠিক তেমনি এআই-নির্ভর অর্থনীতিতে আগামী দশকে আরও নতুন পেশার জন্ম হবে।
তরুণদের জন্য দিকনির্দেশনা
তাহলে একজন নতুন গ্র্যাজুয়েট বা তাঁর উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের এখন কী ভাবা উচিত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেকে কেন্দ্র করে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। অর্থাৎ কে কোন সফটওয়্যার শিখেছে বা কোন ডিগ্রি অর্জন করেছে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো সে কীভাবে নিজের বিশেষ কৌতূহল, শক্তিমত্তা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে। কর্মজীবনের ভবিষ্যৎ হলো ‘মানুষকেন্দ্রিক’, যেখানে প্রযুক্তি কেবল সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
একজন তরুণের সবচেয়ে বড় সম্পদ তাঁর অভিযোজনক্ষমতা, কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। যিনি নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারবেন, তিনিই ভবিষ্যতের কর্মবাজারে টিকে যাবেন। তাই এখন সময় এসেছে তরুণদের শুধু নির্দিষ্ট ডিগ্রির পেছনে না ছুটে নিজেদের দক্ষতা ও সম্ভাবনাকে চিনে নেওয়ার।
বর্তমান চাকরির বাজার নিঃসন্দেহে কঠিন ও অনিশ্চিত। তবে প্রতিটি সংকটের মধ্যেই নতুন সম্ভাবনা জন্ম নেয়। এআই হয়তো কিছু কাজ বদলে দেবে, কিন্তু একই সঙ্গে অসংখ্য নতুন কাজের জন্ম দেবে। তরুণদের উচিত এই পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া, নতুন দক্ষতা শেখা ও নিজেদের অনন্য পরিচয়কে দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করা। কারণ, ভবিষ্যতের কর্মজীবনে সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হবে নিজেকে অতিক্রম করার ক্ষমতা।