ইন্টার্ন থেকে সিইও—টিকটকের শো জি চিউয়ের পথচলা যেভাবে

টিকটকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শো জি চিউফাইল ছবি

সারা বিশ্বের টিকটকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫০ কোটিরও বেশি। এই প্ল্যাটফর্ম শুধু বিনোদন নয়, কোটি কোটি ছোট ব্যবসা, সৃষ্টিশীল তরুণ-তরুণীর জীবিকার উৎস। আর এই প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ আজ নির্ভর করছে একজন মানুষের কাঁধে—শো জি চিউ। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি ফেসবুকে ইন্টার্নশিপ দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন এবং আজ টিকটকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে বিশ্বের অন্যতম বড় প্রযুক্তি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সাদামাটা শুরু: ইন্টার্ন থেকে ব্যাংকার

সিঙ্গাপুরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা শো জি চিউ প্রথমে দেশটির নিয়মানুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। এরপর লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তবে তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানো অধ্যায় শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে এমবিএ করার সময়।

হার্ভার্ডে পড়ার সময়, যখন ফেসবুক ছিল একেবারে নতুন একটি স্টার্টআপ, চিউ সেখানে ইন্টার্নশিপ করেন। তখন হয়তো তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে একদিন ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বের শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতৃত্ব দেবেন। ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রযুক্তি খাতের প্রথম বাস্তব ধারণা দেয়।

হার্ভার্ডের পর তিনি দুই বছর গোল্ডম্যান স্যাকসে বিনিয়োগ ব্যাংকার হিসেবে কাজ করেন। এ সময় তিনি প্রযুক্তি খাতে বড় বিনিয়োগের কাজের সঙ্গে জড়িত হন, যা তাঁর ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিনিয়োগ জগতে উত্থান এবং বাইটড্যান্সের সঙ্গে প্রথম সংযোগ

২০০৮ সালে চিউ যোগ দেন ডিএসটি গ্লোবাল নামের এক শীর্ষ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানে। সেখানে পাঁচ বছর কাজ করার সময় তিনি আলিবাবা, জেডি ডটকমসহ একাধিক প্রযুক্তি জায়ান্টে বিনিয়োগের সুযোগ পান।

২০১৩ সালে তিনি একটি দলকে নেতৃত্ব দেন, যারা প্রথম দিকে বাইটড্যান্সে বিনিয়োগ করেছিল। সেই সময় হয়তো চিউ ভাবতেও পারেননি, একদিন তিনিই সেই কোম্পানির প্রধান পণ্য টিকটকের সিইও হবেন।

আরও পড়ুন

শাওমিতে বড় অর্জন

২০১৫ সালে চিউ চীনের স্মার্টফোন জায়ান্ট শাওমির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) হিসেবে যোগ দেন। তাঁর আর্থিক কৌশলের দক্ষতায় শাওমি দ্রুত আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে।

২০১৮ সালে শাওমির আইপিও ইতিহাস সৃষ্টি করে, যা চীনের অন্যতম বড় প্রযুক্তি আইপিও ছিল। ২০১৯ সালে চিউ শাওমির আন্তর্জাতিক মার্কেটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং কোম্পানির বৈশ্বিক সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই সাফল্য তাঁকে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি জগতে পরিচিত করে তোলে এবং টিকটকের দরজায় নিয়ে আসে।

আরও পড়ুন

টিকটকের নেতৃত্বে যেভাবে 

মার্চ ২০২১ সালে চিউ বাইটড্যান্সে প্রথম সিএফও হিসেবে যোগ দেন। মাত্র দুই মাস পর, মে ২০২১-এ তাঁকে টিকটকের সিইও করা হয়। তখন টিকটক রাজনৈতিক চাপে ছিল। তাঁর পূর্বসূরি কেভিন মেয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় পদত্যাগ করেছিলেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে চিউকে শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনা নয় বরং প্রযুক্তি ও রাজনীতির এক জটিল যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে হয়।

হার্ভার্ডে পড়াশোনার সময় ই-মেইল চালাচালির সময়ে পরিচিত হন স্ত্রী ভিভিয়ান কাওয়ের সঙ্গে পরিচয় শো জি চিউর
ফাইল ছবি

বাইটড্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়িমিং তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘শো আমাদের কোম্পানি ও শিল্পকে গভীরভাবে বোঝেন। তিনি সেই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাঁরা প্রথম দিকে আমাদের মধ্যে বিনিয়োগ করেছিল। তাঁর প্রযুক্তি খাতে এক দশকের অভিজ্ঞতা রয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্র বনাম টিকটক: লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে চিউ

টিকটক যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেও দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন সরকারের নজরদারির মধ্যে ছিল। ট্রাম্প প্রশাসন ২০২০ সালে টিকটকের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ তুলে কোম্পানিকে মার্কিন শাখা বিক্রির নির্দেশ দেন। তবে আদালতের কারণে তা কার্যকর হয়নি। ২০২৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন করে ঘোষণা দেন—বাইটড্যান্সকে ২০২৫ সালের মধ্যে মার্কিন অংশ বিক্রি করতে হবে, না হলে টিকটক যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হবে।

চিউ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিক্রি কোনো সমাধান নয়। তিনি কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ‘টিকটক নিষিদ্ধ করলে ১৫ কোটি মার্কিনি ব্যবহারকারীর কণ্ঠরোধ করা হবে। এটি শুধু প্রযুক্তি নয়, গণতন্ত্রের প্রশ্নও।’

এ সময় টিকটকের ব্যবহারকারীরা চিউর পাশে দাঁড়ান। তাঁর সাক্ষ্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ফ্যানক্যাম’ ভিডিও ভাইরাল হয়, যা তাঁকে তরুণদের কাছে এক ধরনের প্রতীকী নেতায় পরিণত করে।

আরও পড়ুন

সুপ্রিম কোর্টের রায় ও কাউন্টডাউন

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন টিকটক নিষেধাজ্ঞা–সম্পর্কিত আইন স্বাক্ষর করেন। আইনে বলা হয়, ১৮০ দিনের মধ্যে মার্কিন অংশ বিক্রি না করলে টিকটক যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হবে।

টিকটক আদালতে লড়াই চালালেও ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ সুপ্রিম কোর্ট আইনটির পক্ষে রায় দেয়। এখন টিকটকের হাতে আছে মাত্র কয়েক মাস। ১৯ জানুয়ারি ২০২৬-এ চূড়ান্ত সময়সীমা শেষ হবে। এরপর ১৭ কোটি মার্কিন ব্যবহারকারী হারাবেন টিকটক।

চিউ একটি ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘এটি শুধু একটি অ্যাপের লড়াই নয়। এটি সৃষ্টিশীলদের স্বাধীনতার লড়াই, এটি প্রযুক্তিতে অযৌক্তিক সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে অবস্থান।’

মার্কিন কংগ্রেসে আইনপ্রণেতাদের কঠিন জেরার মুখে পড়েন টিকটকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাও জি চিউ।
এএফপির ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

ব্যক্তিজীবন

হার্ভার্ডে পড়াশোনার সময় ই-মেইল চালাচালির সময়ে পরিচিত হন তাঁর স্ত্রী ভিভিয়ান কাওয়ের সঙ্গে। তাঁদের তিন সন্তান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি গলফ খেলা, ভিডিও গেমস খেলা এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বই পড়তে ভালোবাসেন। তবে পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিজীবন সব সময় আড়ালে রাখেন।

চিউয়ের নেতৃত্বের ধরন ও দৃঢ়তা

চিউর নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো শান্ত, কূটনৈতিক এবং তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত। তিনি ‘প্রজেক্ট টেক্সাস’ চালু করেন, যার মাধ্যমে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে মার্কিন ব্যবহারকারীর তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই সংরক্ষণ করা হয়। তিনি সব সময় প্রকাশ্যে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে উপস্থিত হন, যদিও ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সংযত চিউর প্রিয় উক্তি হলো, ‘প্রযুক্তি মানুষের সৃজনশীলতাকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যম।’

আসছে যে চ্যালেঞ্জ

এখন বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ শো জি চিউর দিকে। যদি তিনি টিকটককে বিক্রির বাইরে রেখে রক্ষা করতে পারেন, তবে তিনি প্রযুক্তি ইতিহাসের অন্যতম সফল সিইও হিসেবে বিবেচিত হবেন। যদি ব্যর্থ হন, তবে টিকটক নিষিদ্ধ হবে এবং তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সেই নেতা হিসেবে, যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন।

শো জি চিউ আজ শুধু একজন সিইও নন; তিনি প্রযুক্তি ও রাজনীতির সবচেয়ে বড় যুদ্ধের এক নেতা।

তথ্যসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার