ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত পেশায় যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা

ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত পেশা ফ্রিল্যান্সিংয়ে দেশের নারীরা বৈশ্বিক পর্যায়ে শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছেন
ছবি: সংগৃহীত

‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ অমর বাণী আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছু। পৃথিবীকে এগিয়ে নিতে বা কল্যাণকর করতে এখনো নারী-পুরুষ সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও নারীরা নানান ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন। ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত পেশা ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের নারীরা বৈশ্বিক পর্যায়ে শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছেন। মফস্বলের নারীরাও এখন ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

সফল যাঁরা, কেমন তাঁরা

সিলেটের মেয়ে সৈয়দা নাহিদা আখতার নিপা। গ্রাফিকস ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ‘আমি এখন খুবই ভালো আছি। আগে নিজেকে নিয়ে অনেক চিন্তায় থাকতাম। গ্রাফিকস ডিজাইনিং শিখে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছি।’ এমনটাই জানান নাহিদা আখতার নিপা। তিনি বলেন, পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার সুযোগ পেয়েছি এ প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শেখার ফলে। আশা করি আমার মতো অনেক মেয়েই এ কাজ শিখে নিজেকে আরও বেশি স্বাবলম্বী হতে পারবে।’

আইটি সার্ভিস প্রোভাইডার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন আসমিকা মিথিলা। চট্টগ্রামের মেয়ে আসমিকা মিথিলা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি স্বাবলম্বী। ঘরে বসেই এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। আর্থিক সাহায্য করতে পারছেন তাঁর পরিবারকে এবং নিজেও থাকতে পারছেন আগের চেয়ে অনেক ভালো। প্রশিক্ষণ নিয়ে এ পেশায় আসার আগে মিথিলা নিজেকে অসহায় ভাবতেন। সারাক্ষণ নিজের পরিবার নিয়ে ভাবনায় দিন কাটত। সে ভাবনা কেটে গেছে মুক্ত পেশার আসার পর থেকে।

রংপুরের মেয়ে শারমিনা মাহমুদা কবির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ফ্রিল্যান্সার টু এন্ট্রাপ্রেনিউরে। এ বিষয় প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর এখন তিনি নতুন এন্ট্রাপ্রেনিউর। নিজের কাজ নিয়ে এখন তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁকে দেখে এখন তাঁর এলাকার অনেকেই এন্ট্রাপ্রেনিউর হতে চাচ্ছেন।

নারী ফ্রিল্যান্সার তৈরিতে কাজ করছে সরকার

প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীদের স্বাবলম্বী করতে নানান ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, ঘরে বসে আয় প্রকল্প, শি পাওয়ার প্রকল্প, প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পসহ এমন অসংখ্য প্রকল্প মূলত নারীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য চালু করা হয়। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের নিয়মিত সব ধরনের প্রশিক্ষণ প্রকল্পে নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছেন। সমাজের সব শ্রেণির নারীদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে নারীকে সংগঠিত করে তাঁদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নারীদের বাড়ি থেকে অধ্যয়ন করার সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। ই-লার্নিংয়ের মতো নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রশিক্ষণের দ্বারা নারীরাও এগিয়ে যেতে পারছেন। কাজ করতে পারছেন ঘরে বসে, নিজের এলাকায়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এসব প্রকল্পের বিস্তৃতির ফলে মফস্বল শহর থেকেও নারীরা ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত পেশায় নাম লেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন।

স্বাধীন পেশায় নারীদের আগ্রহ বাড়ছে

পুরুষদের পাশাপাশি এখন অনেক নারী আগ্রহী হচ্ছেন এই স্বাধীন পেশার প্রতি, যাঁদের বেশির ভাগ সফলতা অর্জন করেছেন। এ কারণে তথ্যপ্রযু্ক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সিংকে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন পাইওনিয়ারের বাংলাদেশ ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ইমরাজিনা খান। তিনি মনে করেন, বেশির ভাগ নারীর বাইরে কাজ করার ব্যাপারে পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা থাকায় তাঁদের ঘরে বসেই আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশ বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বলেও তিনি জানান। ইমরাজিনা বলেন, বাংলাদেশে এককভাবে আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেকেই সফলতার সঙ্গে ফ্রিল্যান্সিং করছেন। এটা অনেক বড় কাজের ক্ষেত্র।

বাংলাদেশে নারী ফ্রিল্যান্সার কতজন

বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। এর মধ্যে ১১ শতাংশ, অর্থাৎ ৭১ হাজার ৫০০ নারী ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন। বৈশ্বিক বাজারে সেখানে নারী ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ। ই-প্ল্যাটফর্মের ডেটা বিশ্লেষণের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অনলাইন কাজে ‘শ্রমিক বা ফ্রিল্যান্সার’ সরবরাহে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্বের মোট বাজারের ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে রয়েছে।

নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে ফ্রিল্যান্সারদের সংযোগ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভারত। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। ভারত এই বাজারের ২৪ শতাংশ দখলে রেখেছে। অনলাইনে কাজের জন্য ফ্রিল্যান্সার সরবরাহে বাংলাদেশের পর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্য। এসব ফ্রিল্যান্সার ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাজ করলেও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও টেকনোলজি ক্যাটাগরিতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলো, যারা বিশ্বের মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে গৃহিণীদের আয়ের পথ খুলেছে। গৃহিণীদের লেখাপড়া শিখে শুধু ঘরে বসে না থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ছবি: পিআইডি

ফ্রিল্যান্সিং পেশায় নারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান প্রেসিডেন্টের

দেশজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি সেবার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়াতে এখন যে কেউ ঘরে বসে আয় করতে পারছেন। এ ক্ষেত্রে নারীদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। সম্প্রতি রাজধানী আগারগাঁওয়ে তিন দিনব্যাপী ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০২০’-এর ভার্চ্যুয়ালি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সিং পেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যাতে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারেন, সে ব্যাপারেও উদ্যোগী হতে হবে। এর পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়মিত গবেষণা ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টিতে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। বর্তমানে অন্যান্য খাতে চাকরির সুযোগ কমে এলেও ফ্রিল্যান্সিংয়ের কারণে অসংখ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে গৃহিণীদেরও আয়ের পথ খুলেছে: প্রধানমন্ত্রী

ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত পেশার কারণে কর্মসংস্থানে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগের দিনে গৃহিণীরা আয় করবেন, এমন স্বপ্ন দেখা অনেকটা দুঃসাধ্য ছিল। এখন ইন্টারনেটের প্রসারের কারণে গৃহিণীরাও ঘরে বসে আয় করছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ে গৃহিণীদেরও আয়ের পথ খুলেছে। গৃহিণীদের লেখাপড়া শিখে শুধু ঘরে বসে না থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। তাতে ছেলে-মেয়েগুলো যেমন মাকে কাছে পাবে, আবার সঙ্গে সঙ্গে মা-ও কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। সম্প্রতি ‘ফ্রিল্যান্সার আইডি’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, নিজেরা কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে গৃহিণী যাঁরা, তাঁরাও অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। তাঁদের আর কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কাজ চলছে

নারী ফ্রিল্যান্সারদের অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সারা বিশ্বে ফ্রিল্যান্সারদের ৫৮ শতাংশ নারী। বাংলাদেশে এই সংখ্যাটা মাত্র ১১ শতাংশ। এ সংখ্যাকে আরও বাড়াতে হবে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছি। মেয়েদের অংশগ্রহণ ৫০ ভাগ হলে অনলাইন কাজের ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারে বাংলাদেশই নেতৃত্ব দেবে। অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নারীদের কাজ করার সুযোগটা বেশি। এই খাতে বিশ্বব্যাপী পুরুষদের তুলনায় এগিয়েও রয়েছে নারীরা। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে পুরুষদের আয় যেখানে ঘণ্টায় ২১.৫৭ পাউন্ড, সেখানে নারীদের আয় ২২.৪৩ পাউন্ড। ফ্রিল্যান্সিং এখন একটি বিশাল জগৎ।

অর্থনীতির ভাষায় এটিকে ট্রিলিয়ন ডলার মার্কেট বলা হয়। আমাদের নারীরা যদি এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে তাদের যেমন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসবে, তেমনিভাবে বাংলাদেশও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে লাভবান হবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর বাংলাদেশে অনেক পেশা হারিয়ে গেছে, আবার অনেক পেশা নতুন করে তৈরিও হয়েছে। নতুন পেশাগুলোতে আমাদের তরুণেরা, বিশেষ করে নারীরা অনেক ভালো করছেন। শুধু মুখে নয়, আমি হৃদয় থেকে নারী স্বাধীনতার পক্ষে। তবে প্রকৃত অর্থে নারীদের স্বাধীন হতে হলে তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে।’