কর্মক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ কী

প্রতীকী ছবি

‘ক্রমে আপিস বন্ধ হইবার সময় আসিল। বাড়িমুখো গাড়িগুলো আপিসমহলের নানা রাস্তা দিয়া ছুটিয়া বাহির হইতে লাগিল। আপিসের বাবুরা ট্রাম ভর্তি করিয়া থিয়েটারের বিজ্ঞাপন পড়িতে পড়িতে বাসায় ফিরিয়া চলিল।’ ‘মাস্টারমশাই’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অফিস ছুটির সময়ের যে চিত্র এঁকেছেন, আজও তা প্রায় একই আছে বলা যায়। শুধু যানবাহনে আরও গতি এসেছে। আর থিয়েটারের বিজ্ঞাপন পড়ার শক্তিটুকু কমেছে অফিসফেরত মানুষের। না, কথাটা একেবারে ঠিক হলো না। বরং, এই করোনা বিপর্যয়ের আগেও বিষয়টি এমনই ছিল—বললে অনেক বেশি ঠিক বলা হয়। এখন এই দৃশ্য মিলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বরং তৈরি হয়েছে।


কবিগুরুর ‘মাস্টারমশাই’ গল্পের যতটুকু উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা আরেকটু এগিয়ে নিলে এখনকার বাস্তবতার কিছু হদিস মিলবে। মাত্রই চাকরি খোয়ানো হরলালের দশা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আজ হইতে হরলালের আপিস নাই, আপিসের ছুটি নাই, বাসায় ফিরিয়া যাইবার জন্য ট্রাম কখনো-বা অত্যন্ত উৎকট সত্যের মতো দাঁত মেলিয়া উঠিতেছে, কখনো-বা একেবারে বস্তুহীন স্বপ্নের মতো ছায়া হইয়া আসিতেছে। আহার নাই, বিশ্রাম নাই, আশ্রয় নাই...।’ এই হরলালের সংখ্যা এখন অনেক। বিশেষত শিল্পোন্নত দেশগুলোয় এ বাস্তবতা বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে।


পুঁজির ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ব্যক্তিজীবন ভুলতে বসা মানুষের কাছে করোনাকাল আবার তার ব্যক্তিজীবন ফিরিয়ে দিয়েছে; ফিরিয়ে দিয়েছে পরিবার—এমন কথা তো অনেক বলা হলো। কিন্তু এই আপাত স্বস্তির উল্টো পিঠেই যে বসে আছে ভয়াবহ অস্বস্তির খবরটি। আর তা হলো বেকারত্ব। তা হলো নয়া-স্বাভাবিকতার ঝকঝকে ও নিষ্ঠুর করাত, যা কেটে ফেলছে অনেককেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই। করোনাকালে এক ভীষণ টান পড়েছে ব্যবসায় ও অর্থনীতিতে। লকডাউন আপাত অর্থে জনজীবনকে রুদ্ধ করলেও বিস্তৃত অর্থে এটি কী রুদ্ধ করেনি—সে প্রশ্নই বরং অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে। শুধু বেকার ভাতার আবেদন করা লোকের সংখ্যা আকাশছোঁয়া। একই বাস্তবতা অন্য দেশগুলোতেও।

এই যুগে নাগরিক কর্মক্ষেত্র বলতে মধ্যবিত্তের মনে এক লহমায় যে অফিস ধারণাটি উঁকি দিয়ে যায়, তার অনেক কিছুই বদলে গেছে, যাচ্ছে। অফিস মানে একটি নির্দিষ্ট সময়; সকালের ঘুম ভেঙেই তৎপরতা; জামা পরো, দরকারি সরঞ্জাম নাও, পারলে নাও টিফিনও; তারপর ছোটো। ঘড়িকে পরাস্ত করে সেঁধিয়ে পড়ো চার দেয়ালে। অফিস মানে একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে রোজ বসা, রোজ হাজিরা। অফিস শেষ মানেও ঘড়ির শাসন। অফিস এলে যেমন, তেমনি যাওয়ার সময়ও চিহ্ন রেখে যেতে হয়। আগে হতো সইয়ে, এখন হয় টিপসইয়ে কিংবা চোখের ইশারায়। মাঝেমধ্যে ছুটির আবেদন; সে এক ব্যাপার। কত কী ম্যানেজের খতিয়ান থাকে এর সঙ্গে জুড়ে।
কিন্তু এখন এই নয়া বাস্তবতায় এই সবই সেকেলে ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এখন হোম-অফিস। আবার অনেকের কাছে এসব হয়ে উঠেছে দীর্ঘশ্বাসের নাম। সবখানেই এই এক দৃশ্য। এই যেমন ফরাসি দেশেই করোনার ঝক্কি সামলে অফিসে ফিরতে পেরেছেন ৮৪ শতাংশ কর্মী। যুক্তরাজ্যে এ হার ৪০ শতাংশের নিচে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে এ তথ্য। না, বাকিদের সবার চাকরি গেছে এমন নয়। তাঁদের অনেকেই এখনো ঘরে থেকে কাজ করছেন। কিন্তু ঘরে থেকে কাজ করার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কারণ এ নিয়ে প্রযুক্তি খাতের সব প্রতিষ্ঠানই এমনকি একমত নয়।

টুইটার কর্তৃপক্ষ যেমন মনে করছে, তাদের সব কর্মী সব সময়ের জন্যই ঘরে থেকে কাজ করুন—এটাই তারা চায়। স্বয়ং টুইটারপ্রধান জ্যাক ডোরসি বলেছেন এ কথা। কিন্তু ঠিক বিপরীত মত ব্যক্ত করেছেন নেটফ্লিক্সের প্রতিষ্ঠাতা রিড হ্যাস্টিংস। কর্তারা যা-ই ভাবুন না কেন, ঘরে থেকে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের অনেকেই বিদ্যমান ব্যবস্থায় ঠিক আশ্বস্ত হতে পারছেন না। অনেকেই এভাবে চেনা কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে থাকাটাকে দেখছেন পদোন্নতি, বেতন-ভাতা, কাজের নিরাপত্তা ইত্যাদির জন্য ঝুঁকি হিসেবে। সহকর্মীদের দীর্ঘদিন না দেখার কারণে একধরনের বিষণ্নতাও জন্ম নিচ্ছে অনেকের মধ্যে।


কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বলছে, একটি স্থায়ী সমাধান আসার আগপর্যন্ত এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন বাধ্য হয়ে ভাবতে হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাস্তবতা নিয়ে, ভবিষ্যৎ অফিস সংস্কৃতি নিয়ে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির পরবর্তী ধাপ ও সামাজিক পরিসর কেমন হবে—সেসব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। একটি অফিস তো শুধু অফিস নয়। একে ঘিরে গড়ে ওঠে অনেক ধরনের ব্যবসা, যার সঙ্গে যুক্ত থাকে বহু মানুষ। ফলে কর্মক্ষেত্রের ধরনটি বদলে যাওয়ার প্রভাবটি শুধু ওই প্রতিষ্ঠান বা তার কিছু কর্মীর ওপরই পড়ে না। এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত নানা ক্ষেত্রের ওপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এই পরিস্থিতি একই সঙ্গে ভবিষ্যতের কোম্পানি-ধরনটির দিকেও মনোযোগ দিতে বলে।


বর্তমান বাস্তবতায় অফিস বিষয়টি যেদিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তাতে ‘অফিসপাড়া’ বস্তুটি ভবিষ্যতে বিরল কিছু হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে নগরকেন্দ্রের নতুন সংজ্ঞা কী দাঁড়াবে, তা–ও ভাবনার বিষয়। আজ থেকে দুই শ বছর আগে উল্লিখিত ‘অফিসপাড়া’ শব্দটিই ছিল না। ছিল গঞ্জ বা বাজার, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই কেনাবেচার কাজ চলত। এরপর বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সামনে এল কারখানা যুগ। দলে দলে সম্পদহীন মানুষেরা সেখানে ঢুকে গেল শ্রমিক হিসেবে। তারপর তৈরি হলো আরও আরও স্তর। শ্রমিকদের প্রশাসক হিসেবে একেক স্তরে একেক ধরনের লোক নিযুক্ত হলো। কারখানাকে কেন্দ্র করে নয়া উৎপাদন ব্যবস্থায় জন্ম হলো আধুনিক অফিসের। যন্ত্রই মূলত আজকের অফিস ধারণার নির্মাতা। এই অফিস ক্রমে জায়গা করে নিল নগরের কেন্দ্রে। একটা আবডাল বেছে নিলেও এখানে ওই গঞ্জের মতোই কেনাবেচাই মুখ্য, যার অধিকাংশ কর্মীর জীবন অঞ্জন দত্ত কথিত ‘মাসের প্রথম দিনটার’ মতোই, যার শুরুর দিনের উচ্ছ্বাস দেয় মাস শেষের ‘বেঁচেবর্তে’ থাকার বাস্তবতার আভাস।

পুঁজির ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ব্যক্তিজীবন ভুলতে বসা মানুষের কাছে করোনাকাল আবার তার ব্যক্তিজীবন ফিরিয়ে দিয়েছে; ফিরিয়ে দিয়েছে পরিবার—এমন কথা তো অনেক বলা হলো। কিন্তু এই আপাত স্বস্তির উল্টো পিঠেই যে বসে আছে ভয়াবহ অস্বস্তির খবরটি। আর তা হলো বেকারত্ব। তা হলো নয়া-স্বাভাবিকতার ঝকঝকে ও নিষ্ঠুর করাত, যা কেটে ফেলছে অনেককেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই। করোনাকালে এক ভীষণ টান পড়েছে ব্যবসায় ও অর্থনীতিতে। লকডাউন আপাত অর্থে জনজীবনকে রুদ্ধ করলেও বিস্তৃত অর্থে এটি কী রুদ্ধ করেনি—সে প্রশ্নই বরং অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

সে যাক; অফিস এল, অফিসের ঝঞ্ঝাটও এল। এল অফিসফেরত মানুষের ক্লান্তি। এল একটা অফিসে ঠাঁই করে নেওয়ার লড়াই, যার নাম চাকরি-যুদ্ধ। এল ইন্টারভিউ। কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন কত দারুণভাবে এঁকেছেন এই ইন্টারভিউয়ের চিত্র। সে যা-ই হোক, এমন বহু ধারণা ও তাকে ঘিরে বহু প্রতিষ্ঠান জন্ম নিল। এখন ‘করপোরেট কালচার’ শেখানোর প্রশিক্ষণ হয়। ব্যবসাও কম নয় এসব প্রশিক্ষণদাতা প্রতিষ্ঠানের। ইন্টারনেট ঘাঁটলে পাওয়া যাবে এমন অগণিত ওয়েবসাইটের, যেখানে সযত্নে শেখানো হয় জীবনবৃত্তান্ত থেকে শুরু করে চাকরির ইস্তফাপত্র লেখার নিয়মকানুন। নাগরিক পরিবহনব্যবস্থাই আমূল বদলে গেল অফিস সংস্কৃতির কারণে। দেশ নির্বিশেষে নিম্ন ও মাঝারি পদের অফিসকর্মী মানেই সাতসকালে ছোটো, গাদাগাদি গণপরিবহনে চড়ো, সিঁড়ি ভাঙো এবং সিঁড়ি ভাঙো। কোনো নগরের পরিবহনব্যবস্থা কত উন্নত, তার অন্যতম মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াল অফিসমুখী যাত্রীদের তা কতটা সেবা দিতে পারছে, তার ওপর। ফলে নতুন বাস্তবতায় যদি এই সংস্কৃতি বদলে যায়, তবে পরিবহনব্যবস্থায়ও বদল আসতে বাধ্য।


বারবার এই বদলের সম্ভাবনার সঙ্গে কোভিড-১৯ সৃষ্ট পরিস্থিতিকে জুড়ে দিতে হচ্ছে। কোনো গত্যন্তর নেই। কারণ আজকের হোম-অফিস পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলো বেশ পুরোনো হলেও এত দিন আলোচনায় আসেনি। পিডিএফের কথাই ধরা যাক। এটি এসেছে ১৯৯১ সালে। আজকের সবচেয়ে আলোচিত জুম ও স্ল্যাক প্ল্যাটফর্মের জন্ম এক দশক আগে। ফলে করোনা পরিস্থিতিই পরিচিত কর্মক্ষেত্রের থাকা না–থাকার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে বলা যায়। একটু তথ্যে চোখ বোলানো যাক।
মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মহামারির আগে মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৩ শতাংশ ঘরে থেকে কাজ করত। এখন এ হার ২৯ শতাংশ। আবার এই দুর্যোগে বহু প্রতিষ্ঠান ধসে গেলেও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু এগিয়ে গেছে। মাইক্রোসফট টিমস, জুম, গুগল মিট ও সিসকো ওয়েবেক্সের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর এখন নিয়মিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা সম্মিলিতভাবে ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি নানা দপ্তর, এমনকি আদালতের কাজও এখন হচ্ছে ডিজিটাল পরিসরে।

প্রতীকী ছবি

কথা হলো কাঙ্ক্ষিত সেই ভ্যাকসিন এলে এসব বদল কি সাময়িক বলে বিবেচিত হবে? নাকি এর অনেকগুলোই স্থায়ী হিসেবে থেকে যাবে? এমন অনুমানের জন্য সবচেয়ে ভালো দিকনির্দেশনাটি দিতে পারে সেই দেশগুলো, যেখানে ভাইরাসটির বিস্তার এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের উদাহরণ আগেই দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মরগান স্ট্যানলির করা সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য বলছে, জার্মানির ৭৪ শতাংশ অফিসকর্মী কর্মক্ষেত্রে ফিরেছেন। তাঁরা সশরীরে উপস্থিত হয়ে কাজ করছেন। কিন্তু এই কর্মীদের মাত্র ৫০ শতাংশ সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিসে যাচ্ছেন। বাকিরা এর চেয়ে কম দিন অফিস করছেন। একই ধরনের আরেক জরিপের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন প্রতিষ্ঠান গার্টনার ইনকরপোরেশন জানাচ্ছে, মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭৪ শতাংশ তাদের কর্মীদের অন্তত ৫ শতাংশকে ঘরে থেকে কাজের সুযোগ দেবে।


অর্থাৎ বিষয়টি মূলত নির্ভর করছে নগরের ধরন, সেখানকার অর্থনৈতিক বাস্তবতা, কাজের ধরন, প্রযুক্তির সক্ষমতা ইত্যাদির ওপর। কিন্তু সে না হয় হলো। মূল প্রশ্নটি থেকে যাচ্ছে অফিসকে কেন্দ্র করে যে সংস্কৃতিটি গড়ে উঠল এত বছরে, তার কী হবে। এর সঙ্গে কর্মীর সৃষ্টিশীলতা, দলীয়ভাবে কাজ করার মানসিকতা, নেতৃত্বের ধরন অনেক কিছু জড়িত। নগরকেন্দ্র বলে পরিচিত অফিসপাড়াগুলোর বড় বড় দালানের কী হবে? কী হবে এসব দালান ও বাস-পাতালরেল ইত্যাদি স্টেশন ঘিরে গড়ে ওঠা চা-কফিসহ রকমারি সব দোকান ও এর ব্যবসার? কী হবে পরিবহনব্যবস্থার? কী হবে অফিসফেরত বিষণ্নতার? কী হবে সদ্য চাকরি খোয়ানো রবীন্দ্র-কথিত হরলালদের, যারা না চাইতেই এক অফুরান ছুটি পেয়ে গেল?