বগুড়া থেকে নিউইয়র্কে স্বপ্ন বুনতে চান উদ্যোক্তা ইসরাত জাহান

নিশ্চিত চাকরি ছিল ইসরাত জাহানের। সেই চাকরি বাদ দিয়ে করতে চেয়েছিলেন ভিন্ন কিছু। স্বপ্ন ছিল অনেক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার। সে কাজে ইসরাত জাহান সফলও হয়েছেন। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী নিবেদিত গ্লো-এর গল্পে আজ আমরা শুনব বগুড়ার সফল উদ্যোক্তা ইসরাত জাহানের দুই যুগের পথচলার গল্প। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক পার্থ শঙ্কর সাহা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে তিনি শুনিয়েছেন তাঁর সফলতার গল্প।

শুরুর গল্প

বর্তমানে অনেকগুলো কাজের সঙ্গে যুক্ত নারী উদ্যোক্ত্য ও ব্যবসায়ী ইসরাত জাহান। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোয়। সম্প্রতি যুক্ত হতে যাচ্ছেন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। সঞ্চালক পার্থ শঙ্কর সাহা গ্লো-এর গল্পের শুরুতে জানতে চান ইসরাত জাহানের শুরুর গল্পটি। ‘আমি সাঁটলিপি, শর্টহ্যান্ড, টাইপ, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলাম। আর সেখানে আমার রেজাল্ট ছিল ভালো। তখন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বলেছিলেন, “চাইলে তুমি এখানে চাকরি করতে পারো।” এরপর ওই প্রতিষ্ঠানে আমি কিছুদিন চাকরি করি। কিছুদিন পর আরেকটা প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করি। কিন্তু চাকরি করতে আমার ভালো লাগেনি। চাকরি জিনিসটা আমাকে কখনোই টানেনি।’

ইসরাত জাহানের সব সময়ই মনে হতো নিজে কিছু করলে ভালো হবে, ভালো করতে পারবেন। চাকরি করা অবস্থাতেই বাসায় বসে কাপড়ের ওপর ফুল তোলা, ব্লক-বাটিকের কাজ ও বিভিন্ন রকমের রান্নাবান্না করতেন। পাশাপাশি তিনি প্রথম আলোর নকশা, ভারতের সানন্দা ইত্যাদি পড়তেন। ইসরাত জাহান গল্প করতে গিয়ে আরও বলেন, ‘এগুলো দেখে দেখে ক্রিয়েটিভ কিছু করার ইচ্ছা হতো। এরপর নকশার এক সংখ্যায় রন্ধনশিল্পী রাহিমা সুলতানা রিতা আপার নম্বর পেলাম। কথা বললাম। তিনি আমাকে ঢাকায় যেতে বললেন। আমার এতটাই আগ্রহ ছিল যে তখন আমি বগুড়া থেকে ঢাকায় চলে যাই। ঢাকায় গিয়ে আমি তাঁর অধীনে একটা রান্নার কোর্স করি। এরপর বগুড়ায় ফিরে দৈনিক করোতোয়া ও প্রিয় নকশায় আমার রেসিপি দিলাম। ছাপাও হলো রেসিপিগুলো। এর ফলে আমি ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। তখন আমার আশপাশের মানুষ খুব উৎসাহ দিত আমাকে। সবার উৎসাহে আমি রান্নার একটা কোর্স চালু করি। সকাল-বিকেল দুই বেলায় আমি রান্না শেখানোর ক্লাস করাতে থাকি। প্রতি ব্যাচে ৭০–১০০ জন উপস্থিত থাকেন। এ বিষয়গুলো আমাকে আরও বেশি উৎসাহ দিতে থাকে। ওই কোর্সে সফলতার পর আমি একটি বুটিক হাউস ও পারলার তৈরি করি। এর মধ্যে আমি বিউটিফিকেশনের ওপর কয়েকটি কোর্স করে ফেলি। যাঁরা ঢাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন না, তাঁদের জন্য আমি নিজেই একটা ট্রেনিং সেন্টার তৈরি করি। সেখানেও আমি প্রচুর সাড়া পাই।’ এভাবেই পথচলা শুরু নারী উদ্যোক্তা ইসরাত জাহানের।

সঙ্গে আছে পরিবার

কাজ করতে গিয়ে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি না? সঞ্চালকের এ প্রশ্নের উত্তরে ইসরাত জাহান বলেন, ‘প্রচুর বাধার মুখোমুখি হয়েছি। ভেতরের সমস্যাগুলো আমি সমাধান করেছি। আর বাইরের বাধাগুলো আমার স্বামী দেখে সমাধান করেছে। পরিবার থেকে আমি সব সময় সমর্থন পেয়েছি। পরিবারের সমর্থন না পেলে আসলে কোনো কাজেই ভালো করা সম্ভব নয়। আমার পরিবার, আমার স্বামীর পরিবারও আমাকে অনেক বেশি সমর্থন দিয়েছে, এখনো দিয়ে যাচ্ছে। আমি একটা কথাই বলব, পরিবারের সমর্থন ছাড়া কেউ কখনো সফল হতে পারে না।’

শত বাধা পেরিয়ে

ইসরাত জাহান বলেন, ‘করোনার শুরুতেও আমার প্রতিষ্ঠান ভালোই চলছিল। তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল, সমস্যা তত বাড়ছিল। আমার প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ গারো জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা কাজ করে। এ করোনার মধ্যে তাদের নিয়ে চলতে কিছুটা কষ্টই হয়েছে আমার। অনেক কষ্ট করে, নিজের পুঁজি দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। আমি তাদের নিজের সন্তানের মতো করে করোনার মধ্যে দেখে রেখেছি। আগে মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে সবকিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু করোনার মধ্যে এ নিয়মে কিছু ব্যাঘাত ঘটেছে। পৃথিবীজুড়ে এ মহামারিতে আমাকে টিকে থাকতে আমার কর্মীরা অনেক সহযোগিতা করেছে। সরকারসহ সবার সহযোগিতায় আমরা সবাই মিলে কষ্ট করে হলেও টিকে আছি।’

লক্ষ্য এবার রেস্তোরাঁ

বগুড়া শহরে একটি রেস্তোরাঁ করার ইচ্ছা ইসরাত জাহানের অনেক দিনের। সেই লক্ষ্যেই সবকিছু ঠিকঠাক। এখন শুধু ফিতা কেটে উনুনে আগুন দেওয়ার অপেক্ষা। এ মহামারি না এলে দুই বছর আগেই রেস্তোরাঁ চালু করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেটা কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। নতুন রেস্তরোঁর বিশেষত্ব কী—এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরাত জাহান বলেন, ‘আমার রেস্তোরাঁয় ফিউশন ফুড থাকবে। একই সঙ্গে ক্যাটারিং করার ইচ্ছা আছে। বেকারি ও ফাস্টফুডের খাবারকেও গুরুত্ব দিয়ে রাখা হবে। এ ছাড়া নতুন কিছু আইটেম থাকবে। বগুড়াবাসী সব সময় চায়, আমি খাবারের একটা রেস্তোরাঁ করি। এবার তাদের সে আশা পূরণ হবে। এখন আমার স্বপ্ন—নিউইয়র্কে একটা রেস্তোরাঁ দেওয়া।’

নতুনদের জন্য

ইসরাত জাহান বলেন, সবার আগে কাজটার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। আর এখন নতুনদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে। এসএমই ঋণসুবিধা রয়েছে। এ ঋণ পেতে কোনো জামানত দেওয়ার দরকার হয় না। আর সুদহারও তুলনামূলক কম। চাইলে নারীরা এ ঋণসুবিধা গ্রহণ করে কাজ শুরু করতে পারে।

দেশীয় সংস্কৃতি ধারণ করে

ইসরাত জাহানের ভাষ্য, ‘সবার ওপরে আমার কাছে দেশ। আমি যা–ই করি না কেন, দেশীয় সংস্কৃতিকে প্রধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার পোশাকে কাজগুলোতে সব সময় দেশি মোটিফ থাকে। এ ছাড়া গরিব মেয়েদের উৎসাহ দিই। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। দেশি পণ্য তৈরি করার জন্য সহযোগিতা করি। দেশ ও বিদেশে অনেকেই কাজ করছে, যাদের শুরুটা আমার এখান থেকে।’