শিক্ষক নিবন্ধনের আগে যা বিবেচনা করা উচিত

এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে এনটিআরসিএ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পৃথক, প্রতিটি পদ পৃথক, প্রতিটি আবেদনও পৃথক। আবেদনের আগে জেনে নিতে হবে নানা দিক
ছবি: প্রথম আলো

এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে এনটিআরসিএ। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে দেশের ৫৪ হাজার ৩০৪ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শূন্য পদের সংখ্যা ৩১ হাজার ১০১টি, যার মধ্যে এমপিও ২৬ হাজার ৮৩৮টি এবং নন–এমপিও পদ ৪ হাজার ২৬৩টি। মাদ্রাসা, কারিগরি ও ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় ২০ হাজার ৯৯৬টি পদের মধ্যে এমপিও ১৯ হাজার ১৫৪ এবং নন–এমপিও ১ হাজার ৮৪২টি। ৪ এপ্রিল আবেদন শুরু হয়েছে, চলবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতিটি আবেদনের জন্য ১০০ টাকা ফি দিয়ে পৃথক পৃথক আবেদন করতে হবে। একটি আবেদন করে পছন্দক্রম নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। যথাযথ যোগ্যতা থাকলে একজন প্রার্থী একাধিক প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে আবেদন করতে পারবেন। দেশের যেকোন স্থানে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। পদ শূন্য থাকলে নিজের যোগ্যতা ও ইচ্ছা অনুসারে বাড়ির পাশে, দূরে, বহুদূরে, শহর কিংবা গ্রামের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আবেদন করতে পারবেন।

মনে রাখতে হবে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পৃথক, প্রতিটি পদ পৃথক, প্রতিটি আবেদনও পৃথক। এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরাসরি বদলি হওয়ার কোনো সুযোগ বিদ্যমান নেই। কেন নেই, সে ব্যাখ্যা অনেক বিস্তৃত, অনেক বিতর্কিত। প্রতিষ্ঠান বদলের সহজ কোনো সুযোগ আদৌ তৈরি হবে কি না, হলেও কত দিনে হবে, তা অনিশ্চিত। যখনই হোক, যে নীতিমালা তৈরি করা হবে, সেই নীতিমালায় কে কতটুকু সুযোগ পাবেন, তা–ও অজানা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও এনটিআরসিএ কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুসারে নতুন করে নিয়োগের জন্য আবেদন করে যোগ্যতা প্রমাণ করে নিয়োগ লাভ করে সেখানে গিয়ে নতুন করে যোগদান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সমপদ হলে পূর্ব অভিজ্ঞতা গণনাযোগ্য হবে।

শূন্য পদের বিপরীতে প্রার্থীসংখ্যা অত্যধিক থাকায় যেকোনো প্রার্থী মনে করতে পারেন, তিনি একটি বা দুটি আবেদন করলে তাঁর চাকরি না–ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তিনি নিজের বাড়ির আশপাশে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে এবং অনেক দূরদূরান্তে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার তাগিদ অনুভব করতে পারেন। যে প্রতিষ্ঠানেই আবেদন করুন না কেন; একজন প্রার্থীর অবশ্যই উচিত সেই প্রতিষ্ঠান ও এলাকা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনেশুনে, দেখেবুঝে আবেদন করা। এমনকি নিয়োগ পাওয়ার পরও কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে সেই প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেবুঝে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে দূরবর্তী কোনো প্রতিষ্ঠানে আবেদন ও যোগ দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া উচিত, সেখানে যাতায়াত সুবিধা কেমন, থাকা-খাওয়ার সুবিধা আছে কি না, ছুটিতে বা যখন–তখন নিজের আপনজনের কাছে যাওয়া-আসা করা যাবে কি না; যেসব অসুবিধা আছে, সেগুলো সহজে মেনে নেওয়া যাবে কি না ইত্যাদি।

ফাইল ছবি

অপর দিকে একজন প্রার্থী যে পদে আবেদন করবেন, সেই পদের মর্যাদা কতটুকু, এমপিওভুক্ত কি না, বেতন স্কেল কী, বর্তমান মূল বেতন কত, অন্যান্য ভাতাদির পরিমাণ কত, মাসিক কর্তনের পরিমাণ কত, বিভিন্ন বোনাসের পরিমাণ কত, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট আছে কি না, পদোন্নতির সুযোগ আছে কি না, যে প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবেন, সেখানে সুযোগ-সুবিধা কেমন, আধুনিক শিক্ষকতায় কাজের ধরন-পরিধি কেমন, লেখাপড়ায় লেগে থাকতে ভালো লাগে কি না, শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটুকু, কর্মকালে ছুটি ভোগের বিধান কেমন, অবসরকালে প্রাপ্য সম্ভাব্য আর্থিক সুবিধা কেমন, অন্যান্য পেশার তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কতটুকু কমবেশি, নিজের যোগ্যতা ও মনমানসিকতার সঙ্গে এই পেশা খাপ খায় কি না ইত্যাদি খুব ভালোভাবে জেনে সার্বিক বিবেচনায় মনঃপূত হলেই আবেদন ও যোগ দেওয়া উচিত।

হাজার বছর ধরেই এ দেশের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম ছিল। এখনো আমাদের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অর্ধেকের কম, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের। বর্তমানে এমপিও এর মাধ্যমে সরকার মাধ্যমিক স্তরের একজন সহকারী শিক্ষককে ন্যূনতম মূল বেতন দিয়ে থাকে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা! উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের একজন প্রভাষককে প্রাথমিক মূল বেতন দেওয়া হয় ২২ হাজার টাকা। এ ছাড়া সব স্তরের শিক্ষকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট অনধিক ৫ শতাংশ, বাড়িভাড়া ভাতা ১ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ, বাংলা নববর্ষ ভাতা ২০ শতাংশ দেওয়া হয়ে থাকে। অপর দিকে এই মূল বেতন থেকে অবসর ও কল্যাণ তহবিলের জন্য ১০ শতাংশ টাকা জমা রাখা হয়। নিয়মিত ২৫ বা ততোধিক বছর চাকরি করে অবসরে গেলে কল্যাণ ও অবসর তহবিল থেকে সর্বশেষ মূল বেতনের প্রায় ১০০ গুণ টাকা পাওয়ার বিধান বিদ্যমান। উল্লিখিত সরকারি সুবিধার অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সচ্ছলতা ও বিধিবিধানের ওপর নির্ভরশীল। এই ডিজিটাল যুগে নিজেকে তৈরি করতে জানলে এর চেয়ে অধিক উপার্জনের বহুমুখী সুযোগ দেশে–বিদেশে অবারিত। বেসরকারি শিক্ষকদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কত দিনে কতটুকু বৃদ্ধি পাবে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কতকালে কতটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হবে, তা আরও বেশি অনিশ্চিত। আমার দীর্ঘ অতীত অভিজ্ঞতা তা–ই বলে বারবার।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

কেউ যদি ধারণা করেন অন্যান্য চাকরির তুলনায় শিক্ষকতায় সময়, শ্রম ও মেধা কম দিতে হয়, তবে তা ভুল। শিক্ষকতায় কাজের পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। নিত্যনতুন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য শিক্ষককে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয় প্রতিনিয়ত। আয়ত্ত করতে হয় অত্যাধুনিক পাঠদান ও মূল্যায়ন কৌশল। আত্মনিবেদিত থাকতে হয় সর্বক্ষণ। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্‌যাপনের জন্য ছুটির দিনেও আসতে হয় প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীর কল্যাণার্থে চিন্তাচেতনার দিক থেকে প্রকৃত শিক্ষকের কোনো ছুটি নেই। শিক্ষক হওয়ার আগে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে এসব।

মোট কথা হচ্ছে, না জেনে না বুঝে শিক্ষকতায় এসে কেউ যদি হতাশায় ভোগেন, তাহলে তিনি নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সবকিছু জেনেবুঝে, মেনে নিয়ে, মনে নিয়ে তবেই শিক্ষকতায় আসা উচিত, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকতায়। তা না হলে এখানে এসে সারাক্ষণ মন খারাপ করে, দাবিদাওয়া করে, আন্দোলন করে, দলাদলি করে, অন্যকে দোষারোপ করে, অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে, বিক্ষুব্ধ বা হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজের পেশাকে মন্দ বলে বলে মন্দ সময় পার করে না হওয়া যায় শিক্ষক, না পাওয়া যায় শান্তি, না পাওয়া যায় সচ্ছলতা!

লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন