একই সঙ্গে ভ্রমণ করা আর চাকরি

ইংরেজির পাশাপাশি অন্য কোনো বিদেশি ভাষা জানলে একজন ভ্রমণ গাইড দিনে চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। সিলেটের রাতারগুল থেকে ছবিটি তুলেছেন মোছাব্বের হোসেন

করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে আসায়, দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে অনলাইনভিত্তিক ভ্রমণ গ্রুপও বেড়েছে। এসব ভ্রমণ গ্রুপের মাধ্যমে পর্যটনশিল্পে বড় পরিবর্তন এসেছে। তরুণ-তরুণীরা ট্যুর গ্রুপ পরিচালনার পাশাপাশি নিজেরাও ভ্রমণ গাইড হিসেবে কাজ করছেন। আবার এ সময়ে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, বিভিন্ন পর্যটন সংস্থা ভ্রমণ গাইড নিয়োগ দিয়ে থাকে। ফলে বিনা খরচে বেড়ানো হয়, আবার কিছু টাকা আয়ও হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত প্রবাদ ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’, এর যেন যথার্থ উদাহরণ।

পেশা হিসেবে কেমন

জাতীয় সংসদে সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইড (নিবন্ধন ও পরিচালনা) আইন, ২০২১’ পাস হয়েছে। দেশের পর্যটনশিল্প বিকাশে ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইডের কার্যক্রম পরিচালনা এবং পর্যটকদের স্বার্থ সংরক্ষণে নতুন এই আইন করা হয়েছে। এই আইন থাকার কারণে, এখন ট্যুর কোম্পানিগুলো ভ্রমণ গাইড নিয়োগ দিতে বাধ্য। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) মো. বোরহান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটনশিল্পের বিকাশের ফলে ভ্রমণ গাইড একটি সম্ভাবনাময় পেশা হিসেবে গড়ে উঠছে। আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি বিদেশি পর্যটক আসছেন আমাদের দেশে। লোকাল ভ্রমণ গাইড এবং ফরেন ভ্রমণ গাইড হিসেবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে এ পেশায়। ঢাকা, সিলেট ও বান্দরবানভিত্তিক গাইড বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া অন্যান্য পর্যটন অঞ্চল, যেমন কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোতে গাইডদের চাহিদা বেশি।’

দায়িত্ব ও কর্তব্য

শুধু শখের ভ্রমণকারীরা নন, আলোকচিত্রী ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকারী দল, বন্য প্রাণী গবেষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ভ্রমণ গাইডদের কাজ করতে হয়। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম অভয়ারণ্য সিলেটের প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গাতে ভ্রমণ গাইড হিসেবে কাজ করেন ফয়জুল্লাহ আল নোমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখানো, স্পট সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়া, তাঁদের ছবি তোলাসহ নানা ধরনের কাজ করতে হয়। ঘোরার সময় পুরোটাই কাজের মধ্যেই থাকতে হয়। ভ্রমণের সময় যেকোনো সম্ভাব্য সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। হোটেলে পর্যটকদের আবাসনের ব্যবস্থা, যাতায়াত, খাওয়াদাওয়া ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হয়। দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে পর্যটকদের সত্য বলতে হবে। মনগড়া কিছু বলে পর্যটকদের বিভ্রান্ত করা যাবে না।

কোথায় প্রশিক্ষণ

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীন ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভ্রমণ গাইড বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স করানো হয়। কোর্সগুলোতে ভর্তির ন্যূনতম যোগ্যতা চাওয়া হয় এইচএসসি পাস। তবে শুধু প্রশিক্ষণ নিলেই এ পেশায় ভালো করা যায় না, ভ্রমণ গাইড হতে হলে বিনয়ী ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। ট্যুরিস্ট গাইড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিজিএবি) সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ পেশায় আসতে শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে ভাষাগত যোগ্যতা বেশি জরুরি। বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি অন্য কোনো বিদেশি ভাষা জানা থাকলে এ পেশায় সহজেই ভালো করা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটনস্থল সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।

বেতন ও সুযোগ-সুবিধা

একজন ভ্রমণ গাইডের কাজের সময় যেমন নির্দিষ্ট নয়, তেমনি বেতনও নির্দিষ্ট নয়। কয়েকজন ভ্রমণ গাইডের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি অন্য কোনো বিদেশি ভাষা জানলে প্রতিদিন চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। বিশেষ করে চীনা ও জাপানি ভাষা জানা ভ্রমণ গাইডের চাহিদা বেশি। আর শুধু বাংলা এবং ইংরেজি ভালো জানা থাকলে দিনে আয় দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। সাধারণত দিন ও মাস হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। ভ্রমণ গাইডরা পৃথিবীর নানা দেশের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পান। ফলে তাঁদের নানা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয়। নতুন জায়গা ভ্রমণ যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং, তবে রোমাঞ্চকর। এ রকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অন্য কোনো পেশায় পাওয়া সম্ভব নয়।

অসুবিধা

বান্দরবানের সাকা হাফং পর্বত ও কেওক্রাডংয়ের পর্যটকদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ গাইড হিসেবে কাজ করেন নিউটন বম। তাঁকে অনেকে কেওক্রাডংয়ের নিউটন হিসেবে চেনেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভ্রমণকারী দলের সদস্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যে খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের দু-একজন লোক পড়েন। বিরূপ প্রশ্ন করে বিরক্ত সৃষ্টি করেন। তখন তাঁদের সামলাতে একটু কষ্ট হয়। ভ্রমণ মৌসুমে পর্যটকদের চাপ থাকে। তখন বিশ্রাম নেওয়ারও সময় থাকে না। তবে আমাদের দেশে এখনো সারা বছর ভ্রমণ গাইড নিয়োগ দিয়ে বেতন দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়নি। তাই অনেকে শুধু মৌসুমি পেশা হিসেবে এ পেশায় আসছেন। ভ্রমণ মৌসুম শেষে আবার অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। সবাই প্রতি মাসে আয়ের একটা নিশ্চয়তা চান। এই নিশ্চয়তা না থাকায় অনেকে এই পেশায় আসতে ভয় পান।’

নারীদের জন্যও রয়েছে সুযোগ

দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে ভ্রমণ গাইড হিসেবে কাজ করছেন নুরানি শারমিন। নুরানি শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম যখন কাজ শুরু করি, তখন আমাদের দেশে একদমই অপরিচিত ছিল এ পেশা। বিদেশিদের ঘোরাতে নিয়ে গিয়ে হাতে-কলমে কাজ শিখেছি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ এখন পর্যন্ত ৪০-৪৫টি দেশের ভ্রমণকারী দলকে বাংলাদেশ ঘুরে দেখিয়েছি। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেশা এবং নানা সংস্কৃতি জানার এ পেশায় একবার ঢুকলে নেশার মতো হয়ে যায়, পরে আর বের হওয়া যায় না।’ তিনি বলেন, নারীদের জন্য এ পেশা সম্মানের এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবে নারীরা এ পেশায় আসতে চাইলে পরিবারের সহায়তা লাগবে। পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া নারীদের এ পেশায় ভালো করা সম্ভব না।

একই সঙ্গে ভ্রমণ গাইড ও উদ্যোক্তা

আমার বাংলাদেশ ট্রাভেল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তরুণ-তরুণীরা ট্যুর অপারেটর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে একদিকে যেমন উদ্যোক্তা হচ্ছেন, তেমনি আবার নিজেরাই গাইড হিসেবেও কাজ করছেন। এতে ভ্রমণ গাইডদের মান আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভ্রমণ গাইডকে সম্মানজনক পেশা হিসেবেও মূল্যায়ন করা হচ্ছে। দেশের এমন অনেক পর্যটন স্থান আছে, যা আগে মানুষ চিনত না। ট্রাভেল গ্রুপগুলোর ভ্রমণ গাইডের মাধ্যমেই তা পরিচিতি ও পর্যটন স্পট হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

দরকার প্রচারণা

২০১৫ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সার ভ্রমণ গাইড হিসেবে কাজ করছেন বাদল আহমেদ। ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ইতালি, জার্মানিসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ভ্রমণকারী দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বাদল আহমেদ কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক পর্যটন স্পট, কিন্তু সেগুলো নিয়ে প্রচারণা নেই। আমাদের এখনো ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। অর্থাৎ, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ভারতে যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁরা বাংলাদেশের নাম শুনে তখন আমাদের দেশে আসেন। আমাদের পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে যথেষ্ট প্রচারণা না থাকায়, সরাসরি বাংলাদেশে ভ্রমণকারী দলের সংখ্যা কম। ফলে ভ্রমণ গাইডদের চাহিদাও কম। আমাদের যে পরিমাণ পর্যটন স্থান রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রচারণা করা গেলে ভ্রমণ গাইড পেশা হিসেবে যেমন প্রতিষ্ঠা পেত, তেমনি অনেক তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হতো।’