হঠাৎ দেখা

ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। সামনে কী যেন সমস্যা হয়েছে। ঘণ্টা পাঁচেক সামনের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনতিদূরের এক গ্রাম। দীর্ঘ সময় বসে কাটানোর চেয়ে নতুন এক গ্রামে গেলে মন্দ হয় না। পিঠে ব্যাগটা ঝুলিয়ে আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। কিছুটা সময় হাঁটতে হয়, তারপর ঢুকে পড়ি সেই গ্রামে। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘গ্রামের নাম নন্দপুর’।

আমি হেঁটেই চলছি নন্দপুরের মাটির রাস্তা ধরে। কোথাও যাওয়ার নেই এখানে। যাচ্ছিও না। ছোট ছোট বাড়িঘর। চুপচাপ একটা গ্রাম, গাছগাছালিতে ভরা। মাঝেমধ্যে কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয়, তারা অদ্ভুত ভাবে তাকায় আমার দিকে, কেউ-বা জিজ্ঞেস করে কোথায় যাব। আমি চুপ করে এড়িয়ে চলি সেসব প্রশ্ন।

পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে দেখলাম নেটওয়ার্ক নেই। চোখের সামনে একটা টং দোকান। এক কাপ চা খেয়ে নিই সেখানে বসে। তারপর আবার হাঁটতে থাকি। আমি এমনভাবে হাঁটছি যে কোন দিক দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেছিলাম সেই পথও এখন আর চিনতে পারছি না। আমার অনেক তৃষ্ণা পায়। কিছু না ভেবেই একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ি। এই বাড়িটা গ্রামের অন্য বাড়িগুলো থেকে ভিন্ন। আমি বাড়ির সদর দরজার সামনে থেকে বলছি, ‘কেউ কি আছেন বাড়িতে?’ কিছুটা সময় পর এক ভদ্রলোক বের হলেন। তার কাছেই পানি চাই।

তিনি ভেতরে গেলেন। একটু পর ফিরে এলেন খালি হাতে। বললেন, আসেন, ঘরের ভেতরে আসেন। লোকটির এমন আচরণ আমাকে আশ্চর্য করে। লোকটা নিজে থেকেই বললেন, ‘আমি ভিক্ষুকদেরও বাইরে কিছু খেতে দিই না আর আপনি তো অতিথি। আসেন, ঘরে আসেন।’ এই কথা শোনার পর বাধ্য হয়েই ঘরে প্রবেশ করি। একটি রুমে বসে থাকি। ছাদে তাকাই, না, এখানে বিদ্যুৎও নেই, থাকলে হয়তো ফ্যান থাকত। আমার পিপাসা আর গরম লাগছে। অনেকটা পথ হেঁটেছি। ঘরটি সাধারণ একটি ঘর। বসার একটি সোফা আর কিছু নেই।

একটি হাতপাখা নিয়ে একটা ছোট বাচ্চা ঢুকল রুমে, আমার কাছে দিয়ে আবার চলে গেল। আমি হাতপাখা চালাতে জানি না। তবু চেষ্টা করে গেলাম। আমি জানালার পাশে বাইরে দেখছি, ঘুরে দেখি কে যেন এক কাপ চা, বিস্কুট ও জল রেখে গেছেন। আমি টেরও পাইনি কেউ রুমে এসেছিলেন। আমি জলটাই খেয়ে নিলাম। চা পড়ে রইল। আমি এবার চলে যাব কিন্তু আশপাশে কাউকে দেখছি না। আমি আবার আগের মতো ডাকলাম, কেউ কি আছেন আশপাশে? হ্যালো। ঠিক তখনই একজন নারীর আগমন দেখতে পাচ্ছি। শাড়ি পরা এক নারী আমার সামনে। আমি তাকে চিনি, চিনে ফেলেছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের চোখকে, আমি জীবনে ভাবিনি কখনো আর দেখা হবে! চোখে আমারই অজান্তে জল চলে এসেছে, আমি ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখছি মহিলাটাকে আর বলছি—তুমি? তুমি এখানে? আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নে দেখছি, শরীরে চিমটি কেটে দেখলাম, না স্বপ্ন নয়। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মহিলাটিও কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে বলছে, আমি ভাবিনি এই জনমে আর কোনো দিন দেখা হবে। দেখা যখন হয়েই গেছে এই কথাটি কাউকে বলার দরকার নেই, ট্রেন হয়তো ছেড়ে দেবে, অনেকটা পথ তো হাঁটতে হবে।

আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না, দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাই আবার ফিরে আসি মহিলার সামনে। এসে বলি, তুমি ভালো আছো? কেন তুমি এভাবে পালিয়ে এসেছিলে কারও কথা না ভেবে? এই অজপাড়াগাঁয়ে কেমন করে থাকো তুমি? যেভাবেই থাকো, ভালো থেকো দিদি। মা এখনো লুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদে আর আমার খুব একলা লাগে তোমাকে ছাড়া।

মৌলভীবাজার