ক্যালিফোর্নিয়াতে অবরোধের দিনগুলো

ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে
ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে

কত দ্রুত একটা প্রাণচঞ্চল শহর, দেশ এবং মানুষের জীবন বদলে যেতে পারে, সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বেশ কিছুদিন আগে একটা কাল্পনিক উপন্যাসে পড়েছিলাম, এক পাগল বিজ্ঞানী পৃথিবীর জনসংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে একটা জীবাণু আবিষ্কার করেছে। কারণ, অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে গোটা পৃথিবীর পরিবেশ এবং মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর জীবনের মান হুমকির সম্মুখীন। ঘুরেফিরে সেই ভয়ংকর উপন্যাসটার কথাই মনে হচ্ছে।

আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে হঠাৎ করেই দেশে আসার টিকিট কিনে ফেলি বইমেলায় আসব বলে। ছুটি নেওয়াও শেষ। ভীষণ উত্তেজিত। শেষ মুহূর্তে টিকিট কেনা বলে কিনেছিলাম চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনসে, মোটামুটি দামটা নাগালের মধ্যে ছিল তাই। আরেক বন্ধুরও সে সময় দেশে যাওয়ার কথা। সেই একদিন কথায় কথায় বলল, আমরা একটু চায়নার পরিস্থিতির দিকে খেয়াল রাখছি। কী পরিস্থিতি জানতে শুরু করলাম খোঁজখবর, সেই প্রথম শুনলাম করোনাভাইরাসের কথা।

প্রথমে তেমন পাত্তা দিইনি। এক রাত থাকতে হবে চীনে আসা–যাওয়ার পথে, তারপরেও চিন্তা করিনি তেমন। এরপরই এত দ্রুত পরিস্থিতির অবনতির খবর আসতে থাকল যে ভীষণ দোটানায় পড়ে গেলাম। কখনোই বইমেলায় যেতে পারি না নিজের বই বের হওয়ার সময়, সব পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগও হয়ে গেছে।

এর মধ্যেই অফিসে ই–মেইল এল চায়নায় অফিসের কাজেও কেউ যেতে পারবে না। চায়না দিয়ে কেউ আসা–যাওয়া করলেও দুই সপ্তাহ অফিস করতে পারবেন না, বাসা থেকে কাজ করতে হবে। সত্যিকার অর্থে তখন প্রথম ভয় পেয়েছি। কিন্তু টিকিটের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। এর মধ্যেই সৌভাগ্যক্রমে চায়না ইস্টার্ন ঘোষণা দিল যে কেউ টিকিট বাতিল করে টাকা ফেরত নিতে পারে। তাই করলাম। কিন্তু সেটা ছিল সবে শুরু, তখন একটুও বুঝতে পারি নাই কী ঘটতে যাচ্ছে সামনে। এরপর প্রতিদিন খবর পাচ্ছি চীনের, খবর পাচ্ছি সিঙ্গাপুরের, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরানের। ইউরোপ বা আমেরিকায় বসে আমরা শুধু দুঃখ প্রকাশ করছি। আর যেহেতু আমি যে কোম্পানিতে কাজ করি তাদের পৃথিবীর অনেক জায়গায়ই শাখা–প্রশাখা আছে তারা বারবার সতর্ক করছে এই দেশে যাওয়া যাবে না, ওই দেশে মিটিং বন্ধ এসব।

অতি সম্প্রতি ইতালিতে ছড়িয়ে গেল দাবানলের মতো এ রোগ, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রেও। গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আতঙ্ক ঘনীভূত হচ্ছে। সিলিকন ভ্যালির অনেক কোম্পানি তাদের কর্মচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে বাসা থেকে কাজ করতে বলেছে। লোকজন দোকান খালি করে খাওয়া দাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা শুরু করেছে। এক সপ্তাহ আগে আমি এখানকার এক পাইকারি দোকানে গিয়ে দেখি তাকের পর তাক খালি। বুক ধক করে উঠল। চারদিকে এত থমথমে ভাব। আমার কোম্পানি তখনো বলছে, চাইলে বাসা থেকে কাজ করতে পারো। বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু অফিসে লোকজন প্রতিদিন কমছে, পার্কিং লট ফাঁকা হচ্ছে। ক্যাফেটেরিয়ায় লোক কম। লোকজনের মুখে হাসি নেই, কথা কম। কপালের চিন্তার ভাঁজ। বাচ্চাদের স্কুল খোলা, না পাঠিয়ে উপায় নেই। আবার পাঠাতেও ভয় লাগছে।

এক দেড় সপ্তাহ আগেও আমি যখন শুনলাম দোকানে চাল শেষ, আমি হেসেছিলাম মনে মনে। এত বাড়াবাড়ির কী আছে? আমার ছেলে সিলিকন ভ্যালিতে চাকরি করে। ট্রেনে আসা–যাওয়া করে অফিসে। ট্রেনে সাধারণত দমবন্ধ করা ভিড় থাকে। তাই ওকে নিয়ে একটু চিন্তা হতো। আসলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একধরনের দ্বিধা, আসলেই কি এত ভয়ের কিছু আছে, নাকি নেই? ভিড় কমছে সব জায়গাতেই, স্বাভাবিক জীবনের চিত্র প্রতিদিনই বিঘ্নিত হচ্ছে। জিমে লোক নেই। রেস্টুরেন্টগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার বা ওষুধ ছাড়া অন্য দোকানপাটে একদমই ভিড় নেই। গত দু–তিন দিনের মধ্যে অবস্থার এত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে যে এখনো ধাতস্থ হতে পারছি না। সরকার অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে। প্রথমে বিশ্বের বেশ কয়েক জায়গা থেকে লোকের যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে। একে একে স্কুল–কলেজগুলো বন্ধ হচ্ছিল। জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। অফিস থেকেও বাসা থেকে কাজ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। জনসমাগম বন্ধ। সামাজিকভাবে সবাইকে বিচ্ছিন্ন থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নিত্যব্যবহার্যের জন্য মানুষের লাইন দেখলে একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছিল কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। এই যুদ্ধের ধরনও আলাদা। বোমা, অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ এক অজানা অচেনা জীবাণুর বিরুদ্ধে। আমি দুদিন ধরে বিভিন্ন দোকানেও চাল, ময়দা, তেল, এমনকি ওষুধের অভাব দেখেছি। মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না কয়েক সপ্তাহ ধরে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টয়লেট পেপার বাজার থেকে উধাও। প্রথমবারের মতো দেখলাম জুমার নামাজও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এক অজানা আতঙ্কে গোটা শহর, গোটা ক্যালিফোর্নিয়া কাঁপছে। কোনো এক অশুভ শক্তি চোখের পলকে গ্রাস করে নিল মানুষের স্বাভাবিক জীবন, কর্মকোলাহল, ব্যস্ততা, প্রাণচাঞ্চল্য। নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে আমরা স্ব-অবরুদ্ধ অবস্থায় আছি। জানি না কত দিন চলবে এই অবস্থা। কবে আবার সব স্বাভাবিক হবে, আমরা সবাই প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারব, আশঙ্কামুক্ত হয়ে হাসতে পারব।