করোনার ভ্যাকসিন এবং বর্তমান গবেষণা নিয়ে কথা

করোনাভাইরাস এখন সারা বিশ্বে একটা মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চলছে গবেষণা, যাতে স্বল্প সময়ে একটা কার্যকর ভ্যাকসিন অথবা ওষুধ তৈরি করা যায়।

চীনের উহান শহরে যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে, তার জিনম সিকোয়েন্স অতি দ্রুত নির্ণয় করেছে চীনা বিজ্ঞানীরা। জিনম সিকোয়েন্সকে আমাদের জীবনের নকশা বলা যেতে পারে। এর মাধ্যমে ভাইরাসটির জীবনের নকশাটি অতি দ্রুত পাওয়া গেল।

সার্স (Severe Acute Respiratory Syndrome-SARS) নামে একটি করোনাভাইরাস দেখা গিয়েছিল চীনে ২০০২ সালে এবং মার্স (Middle East Respiratory Syndrome-MARS) নামে মিডল ইস্টে ২০১২ সালে। ধারণা করা হয় সারস ছড়িয়েছিল সিভেট নামের একধরনের বিড়ালের মাধ্যমে মানুষের শরীরে এবং মারসের উৎস ছিল উট। তবে এই দুই ভাইরাসের মূল উৎস হিসেবে বাদুড়কে চিহ্নিত করা হয়েছে।

নতুন এ করোনাভাইরাসের জিনমের মিল পাওয়া গেছে সার্স করোনাভাইরাসের সঙ্গে। কিন্তু ৩৮০টি এমিনো অ্যাসিডের পার্থক্য পাওয়া গিয়েছে। এমিনো অ্যাসিড হচ্ছে আমাদের শরীরের প্রোটিন তৈরির মূল যৌগ। যেহেতু সার্স করোনাভাইরাস, অথবা সার্স-কোভির (SARS-CoV) উৎস হচ্ছে বাদুড়, ধারণা করা হচ্ছে এই নতুন ভাইরাস বাদুড়ের মাধ্যমে বেজি–জাতীয় একটি প্রাণী প্যাংঙ্গোলিনের মাধ্যমে মানুষের কাছে আসতে পারে। তবে বিষয়টা এখনো আলোচনায় আছে। এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ ভাইরাসের জিনম সিকোয়েন্সের এই ভিন্নতার কারণে এটাকে নতুন করোনাভাইরাস বলা হচ্ছে এবং নতুন নামকরণ করা হয়েছে সার্স কোভি-২ এবং এর সংক্রমণকে বলা হচ্ছে কোভিড-১৯। এ ছাড়া অন্য কিছু দেশও কোভিড-১৯ রোগীদের কাছ থেকে স্যাম্পল নিয়ে ভাইরাসটির জিনম সিকোয়েন্স করেছে। ফ্রান্সের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের ফলাফলের মাধ্যমে এটা জানা গেছে, ভাইরাসটি জিনমের মিল রয়েছে বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত অন্য রোগীদের সঙ্গে।

করোনাভাইরাস গোল আকৃতির। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখলে মনে হবে এর উপরিভাগে কিছু ভাইরাসের বস্তু বের হয়ে আসছে। মনে হবে উপরিভাগ দেখতে অনেকটা সূর্যের মতো অথবা ভাইরাসটি মুকুট পরে আছে, তার জন্য এর নাম করোনা। এদের বলা হয় স্পাইক।

কিন্তু এর সুন্দর অবয়ব দেখে মোহিত হলে হবে না, কারণ করোনাভাইরাসের এই স্পাইকে অবস্থিত প্রোটিন হচ্ছে এদের মানুষের কোষে প্রবেশের হাতিয়ার। আপনি যেমন আপনার বন্ধুর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলে কোলাকুলি করেন, এরা আমাদের কোষের উপরিভাগে এ রকম আর একটি প্রোটিন বন্ধুর সঙ্গে যুক্ত হয়। আপনার বন্ধু যদি চোর হয়, সে ঘরে ঢুকে আপনার জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। করোনাভাইরাসের দরকার হচ্ছে আপনার ঘর, তাই এই স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস মানুষের কোষের উপরিভাগের পর্দার সঙ্গে যুক্ত হয়। আপনি যেমন আপনার ঘরের দরজা খুলে দিলেন চোরের কাছে, তেমনিভাবে ভাইরাসের জিন মানে ভাইরাসের ডিএনএর একটি কার্যকর অংশ আপনার শরীরের কোষে ঢুকে তার নিজের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে। সার্স ভাইরাসটি আমাদের কোষের উপরিভাগে কোনো প্রোটিনটির সঙ্গে যুক্ত হয় তা আমরা জানি। এই নতুন ভাইরাসটিও স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে সেই একই প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর নাম হচ্ছে এসিই২। দেখা গেছে সার্স কোভির চেয়ে বর্তমান সার্স কোভি-২, মানুষের কোষের উপরিভাগে ১০ থেকে ২০ ভাগ বেশি পরিমাণে এসিই২ প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। সম্ভবত এই কারণে কোভিড-১৯–এর সংক্রমণের মাত্রা বেশি।

এ ভাইরাসের এখনো কোনো ভ্যাকসিন অথবা কার্যকর ওষুধ নেই। ভাইরাসটির জীবনের নকশাটি বের করার পর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থেকে শুরু করে, বিভিন্ন ওষুধ এবং বায়োটেক কোম্পানি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারটা অনেকটুকু এগিয়েছে। তবে কতটুকু সাফল্য আসবে তা আমরা অচিরেই জানতে পারব। তবে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করা, যা স্পাইক প্রোটিনগুলোকে আমাদের কোষের উপরিভাগের প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধা দেয়। সাধারণত দুর্বল অথবা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস দিয়ে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়। দুর্ভাগ্য যে সার্সের অ্যান্টিবডি সারস কোভি-২–এর স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে ভালোমতো যুক্ত হতে পারে না।

ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অস্টিনের একটি গ্রুপ, এই নতুন ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের আকৃতি কিছুদিন আগে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে অ্যান্টিবডি যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা আরও নিখুঁতভাবে জানা যাবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরি করা একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের ভাইরাসের ক্ষেত্রে সাফল্য কম। দ্রুতগতিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নতুনভাবে ভ্যাকসিন এবং অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

মডার্না থেরাপিউটিকস নামে একটি ইউএসভিত্তিক কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে একটা নতুন ভ্যাকসিনের ব্যাপারে। এরা যেটা করছে, তা হলো এরা ভাইরাসের একটি জেনেটিক বস্তু, যাকে আমরা বলি মেসেঞ্জার আরএনএ, সেটা তৈরি করেছে। এই ভাইরাসের আরএনএটি শরীরে প্রবেশ করালে এটা কোষে ভাইরাসের উপরিভাগে উপস্থিত স্পাইক প্রোটিনের একটি অংশ তৈরি করবে। আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যেকোনো ধরনের বাইরের বস্তু আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে তা বুঝতে পারে এবং এটাকে মারার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই প্রোটিনটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিরক্ষা পদ্ধতি এটার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। শরীরের এই মজুত অ্যান্টিবডি পরবর্তী সময়ে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবে। এ কোম্পানি সিয়াটলে বেশ কিছু সুস্থ ভলান্টিয়ার জোগাড় করেছে এটা প্রয়োগ করার জন্য।

কানাডায় অবস্থিত একটি বায়োটেক কোম্পানি মেডিকাগো, যা মিতসুবিশি তানাবি ফার্মা কোম্পানির সাবসিডিয়ারি, এখন দাবি করেছে তারা করোনাভাইরাসের একটি ভাইরাস-লাইক-পার্টিকেল তৈরি করেছে। এদের সংক্ষেপে বলে ভিএলপি। এই ভিএলপি অনেকগুলো প্রোটিনের দ্বারা তৈরি এবং এদের আকার এবং গঠন মূল ভাইরাসের মতোই কিন্তু এদের মধ্যে ভাইরাসের জেনেটিক বস্তু নেই। এই ভ্যাকসিনগুলো সফল হলে এটা নিরাপদ কি না, সেটা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু ধাপ পেরোতে হবে। তারপর অনুমতি মিললে সারা বিশ্বে বড় আকারে বিতরণ করা হবে।

গিলিয়াড সায়েন্স নামে একটি আমেরিকান বায়োটেকনোলজি কোম্পানির একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এখন ছোট আকারে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। এটার নাম রেমডেসিভির এবং এদের বৈজ্ঞানিক ভাষায় আমরা বলি নিওক্লিওটাইড অ্যানালগ। এটা আমাদের ডিএনএ যে মূল যৌগ দিয়ে তৈরি, তার মতো একটি যৌগ। এই ধরনের কিছু ওষুধ বর্তমানে এইচআইভি ভাইরাসের প্রতিরোধে ব্যবহার হয়ে থাকে। রেমডেসিভির তৈরি করা হয়েছিল আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য। এটা একটা ব্রড স্পেকট্রাম ভাইরাস প্রতিরোধক। তার মানে এটা বেশ কিছু ভাইরাস, যেমন: নিপা, মার্স, সার্স, ইবোলা এবং আরও কিছু ভাইরাসের প্রতিরোধে কাজ করে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে এই ওষুধ ওয়াশিংটন স্টেটের একজন একজন রোগীর ক্ষেত্রে অনুমতি সাপেক্ষে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই রোগী সার্স কোভি-২–এ আক্রান্ত হয়ে নিউমোনিয়ার ধাপে চলে গিয়েছিলেন। এই ওষুধ প্রয়োগের ফলে রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

এটার একটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়েছে চীনে। যদিও রেমডেসিভিরের সারস কোভি-২ প্রতিরোধে কিছু সাফল্য আছে কিন্তু সার্বিকভাবে ব্যবহারের জন্য এখনো অনেক বিতর্ক রয়েছে এবং এর জন্য আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন।

এ ছাড়া একটি ডাচ্‌ এবং জার্মান গবেষণা গ্রুপ সারস এবং সারস-কোভি-২ সংক্রমণকে দমন করতে পারে—এমন একটি হিউম্যান অ্যান্টিবডির কথা সম্প্রতি জার্নালে রিপোর্ট করেছে। এ ছাড়া স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে—এ রকম নতুন প্রোটিনকে টার্গেট হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে নতুন ওষুধ তৈরি করার ব্যাপারে।

এই লেখায় করোনাভাইরাসের কিছু গবেষণা সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করলাম সাধারণ পাঠকদের জন্য। এ ছাড়া আরও অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রচলিত পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন এবং অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লেখাটি প্রকাশ হওয়ার আগেই হয়তো আরও কিছু ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে মূল্যায়নের জন্য চলে আসবে।

বিজ্ঞানের গবেষণা গুলো ধাপে ধাপে আগায়। এ গবেষণাগুলোর জন্য আজকে যক্ষ্মা, গুটিবসন্ত, চিকেন পক্স, মাম্পস, হাম, ফ্লু, পোলিও—এমন অনেক মহামারি থেকে আজকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। বিজ্ঞানের প্রতিটি অথেনটিক গবেষণা, প্রায়োগিক অথবা মৌলিক হোক এই অগ্রগতিতে সাহায্য করে। অদূর ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের একটি কার্যকর ভ্যাকসিন এই গবেষণার মাধ্যমেই আমরা পাব, সেটাই আমাদের আশা।

করোনাভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্বে এখন একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে, স্কুল–কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমেরিকায় এখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বড় বড় সভা, এমনকি খেলা এখন বন্ধ।

সবারই চেষ্টা করা উচিত যাতে এটা না ছড়ায়। যেমন: ঘন ঘন হাত ধোঁয়া, হাঁচি–কাশির সময় নিজেকে সুরক্ষা করা এবং দরকার না পড়লে প্রচুর মানুষের প্রোগ্রামগুলোকে যতটা সম্ভব পরিহার করা। একটি কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কিছুটা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রয়োজন আছে। কাজেই সচেতনতা তৈরি করাটা জরুরি। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন, এটাই কামনা।

*লেখক: ড. সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট আরলিংটনের রসায়ন ও প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক।

তথ্য সূত্র:
https://www.usatoday.com/in-depth/news/2020/03/09/biotech-international-effort-makes-big-push-for-coronavirus-vaccine/4927298002/
https://www.telegraph.co.uk/global-health/science-and-disease/coronavirus-vaccine-covid-19-treatments/
https://www.nih.gov/news-events/nih-research-matters/novel-coronavirus-structure-reveals-targets-vaccines-treatments
https://www.cell.com/cell-host-microbe/pdf/S1931-3128(20)30072-X.pdf
https://www.statnews.com/2020/03/02/coronavirus-drugs-and-vaccines-in-development/
https://www.gilead.com/purpose/advancing-global-health/covid-19