একটি মহামারি এবং আমার একটি প্রশ্ন

আজকাল মানুষের চা-কফির আর সামাজিক মাধ্যমের আড্ডার গরম টপিক হচ্ছে করোনাভাইরাস। চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে বেশ কয়েকটা ফোনও পেয়েছি। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, আমরা কীভাবে বাঁচতে পারি। কখনো চিকিৎসকদের সান্ত্বনা দিচ্ছে, কখনো প্রশংসা। আমি সবাইকে আজকাল যা জানা যাচ্ছে, তাই বললাম শুধু আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা পাল্টে পাল্টে।

না, আমি করোনার ওপর নতুন কোনো তথ্য দেওয়ার জন্য আজ লিখছি না। আমি আমার মনে বেড়ে ওঠা একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি। প্রশ্নের উৎস কোথায়, তার একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে অন্য ভাইরাল জ্বরের মতোই গলাব্যথা বা খুসখুস করা, জ্বর, সর্দি, হাঁচি-কাশি, শরীর ব্যথা হয়। চিকিৎসাও একই, বাসায় থেকে বিশ্রাম নেওয়া, অনেক পানি খাওয়া, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। তবে অনেক সংক্রমিত হলে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, নিউমোনিয়া-মিডিল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (MERS-CoV)/অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোমের (SARS-CoV) মতো প্রাণঘাতী অসুখে রোগীরা ভোগেন, যা থেকে অনেকে উত্তরণ করতে পারেন না। এই ভাইরাসের এখনো কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। আর দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে অনেক দেশে এটা পরীক্ষা করার মতো যথেষ্ট সামগ্রী নেই। তবে এটা শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে না উন্নত বিশ্বেও একই সমস্যা। আর এই রোগ মহামারি আকারে বাড়তে থাকলে এটা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে আঘাত হানবে। আসলে উন্নত বিশ্বে আঘাত হানছে। অনেকে তার চাকরি হারাতে শুরু করেছে এবং কত হাজার মানুষের চাকরি যেতে পারে আগামী কয়েক মাসে তার আভাস ও পত্রিকায় আসা শুরু করেছে।

কিন্তু পড়লে দেখতে পাবেন যে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস আমাদের শরীরে বা পশুপাখি থেকে এলেও আমরা সংক্রমিত হই তখন, যখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকে কোনো অসুখের কারণে অথবা আমাদের নিজেদের অপরিচ্ছন্নতার কারণে। এটা সত্যি যে সব রোগের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, কিন্তু অধিকাংশ চর্মরোগ, এজমা, ভাইরাল জ্বর, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটা কথা সাধারণত সব ডাক্তার বলে যে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবেন। এত সাধারণ একটা মাধ্যম, যা আমাদের স্টাফ অরিয়াস, ই-কলাই, করোনাভাইরাসের মতো মহামারি কেউ রোধ করতে পারে। কিন্তু আমাদের সব সময় একটা হিরোর দরকার হয় যে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। বর্তমানে হিরো বানানোর চেষ্টা হাসপাতালের কর্মী আর বিজ্ঞানীদের যাতে ওষুধ দিয়ে তারা সমস্যার সমাধান করে। কেউ কি একবারও ভেবেছেন তারাও মানুষ, তাদেরও বাচ্চা, পরিবার আছে? তাদেরও জানের ঝুঁকি আছে?

আজ যে করোনাভাইরাসের জন্য সবাই হঠাৎ করে নতুন ফ্যাশনের মতো হ্যান্ড জেল আর মাস্ক লাগিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন ... ভেবে দেখেছেন কেউ এই সচেতনতা আগে থেকে থাকলে আজ কোনো ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়া এত প্রাণঘাতী হতো না। একটু দেখে নিই কী করতে হতো।

ঘরের কাজ
* বাইরে পরিধানের বা রাতের ঘুমানোর জামাকাপড় প্রতিদিন সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা
* বাসায় যার যার তোয়ালে আলাদা থাকা উচিত, গোসলের প্রতিদিন সাবান দিয়ে ধোয়া এবং হাত মুখ মোছার ২ দিন পরপর
* বিছানা–বালিশের কভার প্রতি সপ্তাহ/দুই সপ্তাহে পাল্টানো
* কারও ব্যবহৃত গ্লাস বা চামচ ইত্যাদি দিয়ে না খাওয়া...থালাবাসন নিয়মিত পরিষ্কার করে খাওয়া
* সব খাবার ধুয়ে খাওয়া এবং ধুয়ে রান্না করা
* যেকোনো কাজ শুরুর আগে এবং শেষে হাত ভালোভাবে ধোয়া,সেটা বাথরুম হোক অথবা ঘর ঝাড়ু হোক
* ঘর নিয়মিত পরিষ্কার করা, কারণ ময়লা দেখা যাচ্ছে না তার মানে এই নয় যে ময়লা নেই
* বাগান পরিষ্কার করা

বাইরের কাজ
* ময়লা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা
* নিজের কাজের ডেস্ক পরিষ্কার রাখা।
* কাজ শুরুর আগে হাত ধোয়া এবং বের হওয়ার আগে হাত ধোয়া
* সিগারেট বা মদ না খাওয়া
* নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আড্ডা মারা
* চর্বি বা তেলজাতীয় খাবার কম খাওয়া এবং খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়া
* শীতের ত্রাণ দেওয়ার মতো একজোট হয়ে নিজ কর্মসংস্থানের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা এবং পরিবেশের ওপর তার প্রভাব নিয়ে সবাইকে সচেতন করা।

অসুখে কী করণীয়
সংক্রমিত রোগের ক্ষেত্রে
১.
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, যাতে পরিবার এবং আশপাশের মানুষ সংক্রমিত না হয়। এটা রোগীদের নিজেরই পালন করা উচিত। যে চায়ের দোকানে করোনা নিয়ে আলাপ করবেন, সেখান থেকেই করোনা নিয়ে অথবা দিয়ে বাড়ি আসবেন। তাই দূরত্বটাই সবচেয়ে সহজ।

খবরে দেখলাম মাস্ক পরার ধুম পড়েছে...ব্যবসাও মন্দ নয়। এ সময় বা যেকোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী চাইলে মাস্ক পরতে পারেন, কিন্তু একবার খুললে সেটা তখনই একটি নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার নিশ্বাসের সঙ্গে যে ড্রপলেট মাস্কে লেগেছেম সেটা খোলার পর আপনার হাতে ছড়িয়ে গেছে। পকেটে রাখলে...জামা কাপড়ে। সুস্থ ব্যক্তি পরলেও একই নিয়ম। পরে লাভ নেই, যদি সেটা ঠিকমতো ব্যবহার না করতে পারেন। কারণ, কিছু ব্যাকটেরিয়া আমাদের মধ্যে এমনি বসবাস করে, তারা ততক্ষণ চুপ থাকে যতক্ষণ আমরা নোংরা–ময়লা দিয়ে দিয়ে ওটাকে না খোঁচাই।

২.
অসংক্রামক রোগীদের ক্ষেত্রেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা ভালো। আমরা দেখতে যাওয়া আর উপকার করার নামে ১০ জন গিয়ে মাছের বাজার বসিয়ে দিই...যেখানে কাজ করে ২ জন। তাই ১০ জনের যদি সত্যি সদিচ্ছা থাকে, কাজ ভাগ করে নিলে বাকি পরিবারের ওপর চাপ কমে যায়।

একটা রোগ ভালো হওয়ার জন্য ওষুধ, ভালো খাবারের পাশাপাশি বিশ্রাম অনেক জরুরি। কারণ অসুখের কয়েক দিনের মধ্যে আপনার যখন মনে হয় যে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি, তাহলে আমার শরীর আরও খারাপ হচ্ছে আসলে তা নয়, আপনি দুর্বল, কারণ আপনার তরফ থেকে সৈনিক শ্বেতকণিকা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। আপনি ঘুমালে ওরাও শান্তিমতো লড়াই করতে পারে। একটাই মগজ আমাদের, যা সবকিছু কন্ট্রোল করে। সে আপনার চারপাশের বকবক শুনবে না বাকি অঙ্গগুলো কন্ট্রোল করবে আপনাকে সাহায্য করার জন্য।

যেকোনো রোগীকে আলাদা একটা ঘরে রাখা ভালো। কারণ তার পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বিষয়টা অন্যদের থেকে বেশি খেয়াল রাখা উচিত। তার সবকিছু আলাদাভাবে ধুয়ে রাখা উচিত তত দিন পর্যন্ত, যত দিন সুস্থ না হোন। এর মানে একঘরে করে ফেলা নয়, কারণ সব অসুখে একঘরে করা লাগে না। একটি নির্দিষ্ট ঘরে যেখানে মানুষের যাতায়াত কম, সেখানে বিশ্রাম নেওয়া সহজ।

ওপরের এগুলো আমাদের সব মানুষের জানাশোনা নিত্যদিনের কাজ। কিন্তু অনেকেই সেটা ঠিকমতো পালন করি না। আমাদের দেশের মানুষ ভেতরে পরিষ্কার, বাইরে না আর এরা বাইরে পরিষ্কার ভেতরে না। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক সচেতন আর নিজেরা অচেতন। এ ব্যাপারে আমাদের দেশি আর বিদেশি ভাইদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই।

আপনারা কি জানেন, আমাদের জামাকাপড়, তোয়ালে, গ্লাস ব্যবহারের পর তার থেকে স্যাম্পল নিলে দেখা যাবে তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া কাউন্ট ৫০০-২৫০০ এবং তার মাঝে ১৪ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে স্টাফ অরিউস, ই–কলাই পাওয়া যাবে, যা নিউমোনিয়া, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের শুধু প্রধান কারণই নয়, অনেক বাচ্চা, ইমিউন দুর্বল মানুষ এবং বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর বড় কারণ। ২০১৬ সালের বিশ্ব গণনায় এগুলোর কারণে মৃত্যুর হার ১৪ লাখ থেকে বেড়ে ৩০ লাখে পৌঁছেছে। করোনার মতো মহামারি না হলেও প্রতিবছরের ঘটনা।

নিজের ঘরের এবং নিজের পরিবারের প্রতি যে মায়া, সেটা নিজের সমাজ আর নিজের দেশের ওপর থাকলে আজ দেশ এবং বিশ্ব অনেক সুন্দর হতো...অনেক ভাইরাস–ব্যাকটেরিয়া ফাঙ্গাস...পরিবেশে থাকলেও আমরা লড়াই করতে সক্ষম হতাম...একটা ওষুধ আপনাদের কত সুরক্ষা দেবে আর কতবারই–বা দেবে।

এই করোনা তো একদিন না একদিন চলে যাবে, কিন্তু যে ই–কলাই, স্টাফ আউরিয়াস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু ইত্যাদি এখনো আছে এবং এ রকম অসচেনতা চলতে থাকলে যুগের পর যুগ চলতে থাকবে। হয়তো আরও নতুন কিছু আক্রমণ করতে থাকবে। আজ ওষুধ বের হবে, কিন্তু একসময় তার কার্যকারিতা শেষ হবেই।

আমার মনে আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এটাই যে এই মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে কি আমরা নিজেদের পাল্টাতে পারব, না প্রতিবারের মতোই একটা নতুন ওষুধ এবং জীবন দেওয়ার জন্য হিরোর অপেক্ষায় থাকব?