কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তিনটি ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ

২২ মার্চের বাংলাদেশের পরিস্থিতি। ছবি: সংগৃহীত
২২ মার্চের বাংলাদেশের পরিস্থিতি। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরই বাংলাদেশে এরই মধ্য ভোট হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপি-মেয়ররা নির্বিঘ্নে মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাধারণ মানুষসহ কেউ কোনো সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেইন্টেইন করছেন না। তারা নিজেরাও অনুধাবন করছেন না যে কতটা ঝুঁকি নিচ্ছেন, নিজেদেরই তাঁরা ঝুকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তিনটি ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ।

১.
ম্যাসিভ টেস্ট: যাতে কোভিড–১৯ রোগীকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলা যায়।
২.
আর্লি টেস্ট: যাতে রোগ বেশি দূর ছড়াতে না পারে।
৩.
হাসপাতাল ক্যাপাসিটি: ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যা হাসপাতালের ক্যাপাসিটির মধ্যে না থাকলে রোগী বেশি মরবে।

দেশের জনগণ ও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করার জন্য তাত্ক্ষণিক, সাহসী এবং সুস্পষ্ট পদক্ষেপ এখন জরুরি ভিত্তিতে আবশ্যক। দেশের সব বিশেষজ্ঞই এখন বলছেন বেশি বেশি কোভিড–১৯ টেস্ট করে শনাক্ত করে তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ, যত বেশি টেস্ট, তত বেশি রোগী শনাক্তকরণ; তত বেশি রোগীদের সুস্থ মানুষ থেকে পৃথককরণ, তত কম রোগ ছড়াবে। যত কম রোগী, তত কম হাসপাতালের ওপর চাপ। আর যত কম হাসপাতালের ওপর চাপ, তত বেশি রোগী চিকিৎসা পেয়ে ভালো হয়ে উঠবে। হাসপাতালের ক্যাপাসিটি আর রোগীর সুচিকিৎসা এখানে সরাসরি জড়িত।

সরকার (১-৮) আর প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর (৯-১১) করোনা মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ—

১.
জাতীয় লকডাউন। সংক্রমণ হ্রাস করতে সব অপ্রয়োজনীয় ক্রিয়াকলাপ এবং সব ধরনের সমাবেশ (সামাজিক বা অন্যথায়) বন্ধ করতে হবে। এতে সরকার আর হাসপাতালগুলো হাতে যে সময় পাবে, তাতে হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল ক্যাপাসিটি বাড়াতে পারবে আর প্রয়োজনীয় প্ল্যান করতে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারবে। না হলে হেলথ কেয়ার সিস্টেম ভেঙে পড়বে, যেভাবে পড়েছে ইতালি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে আমেরিকাও এই পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। কারণ, ইতালি আর আমেরিকা দুই দেশই অনেক দেরিতে শহর উপশহরগুলোকে লকডাউনের আওতায় নিয়েছে। সে পথে হাঁটেননি সিঙ্গাপুর আর দক্ষিণ কোরিয়া। সেই কারণে সিঙ্গাপুর আর দক্ষিণ কোরিয়ায় কোভিডের রোগীর সংখ্যা অনেক হলেও মৃতের সংখ্যা কম।

২.
কোভিভ–১৯ পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ান। চীন থেকে আমদানি করুন, তুরস্ক থেকে টেকনোলজি আনিয়ে নিজেরা বানান কিংবা অন্য যেকোনো দেশ কিংবা নিজেদের জানা থাকলে নিজেরাই টেস্টিং কিট বানান। রি-এজেন্ট আমদানি করুন। বিশ্বের রি-এজেন্টের চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। গণস্বাস্থ্যের র‌্যাপিড ব্লট টেস্ট আসলেই এনওসিভি (‍nCOV) শনাক্তে সক্ষম হলে দ্রুত তা সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করুন। আমাদের রোগী শনাক্ত করতেই হবে, এরপর তাদের আইসোলেট। না হলে সারা দেশের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বেন একসঙ্গে। আর দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে ভেঙে পড়বে।

৩.
পরীক্ষা করে ডেটা সংগ্রহ করতে হবে। রোগীর সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে, তা গ্রাফ করে দেখতে হবে। হাসপাতালে কত বেড আছে, তার সঙ্গে রোগীর সংখ্যা কীভাবে অ্যাডমিটেড হচ্ছে, তার তুলনামূলক গ্রাফ করতে হবে। এতে বুঝতে পারবেন কবে নাগাদ হাসপাতাল ফুল ক্যাপাসিটিতে চলে যাবে, আর তার আগেই টেম্পোরারি হাসপাতাল বানিয়ে ফেলতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন হোটেল, ছাত্রদের বাড়িতে পাঠিয়ে তাদের হলগুলোকে ব্যবহার করতে পারেন, কিংবা সেনাবাহিনীর ফিল্ড হাসপাতালের স্টাইল ফলো করা যেতে পারে। এই ডেটা দেশে কত ভেন্টিলেটার আছে, তার জন্যও ব্যবহার করতে হবে। এতে সহজেই বোঝা যাবে যে কত বাড়তি ভেন্টিলেটার প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী অর্ডার করতে হবে। জেনেছি ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট (ইয়াং আর ওল্ড) সবার জন্যই ভেন্টিলেটর এবং অক্সিজেন প্রয়োজন। না হলে রোগী প্রচণ্ড ভুগবে। কোভিডের অন্যতম প্রধান লক্ষণ শ্বাসকষ্ট।

দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ব্যবসাগুলোকে কোভিড মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি-আইটেম বানাতে আদেশ করতে পারে সরকার। পোশাক কারখানাগুলোকে চিকিৎসকদের জন্য গাউন/মাস্ক/কাভার বানাতে আদেশ করতে পারে সরকার। তবে অবশ্যই কোড মেনে বানাতে হবে। অতিরিক্ত মাস্ক বানিয়ে জনগণের কাছে বিনা পয়সায় কিংবা সুলভ মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থাও করতে হবে।

৪.
দেশ এখন যুদ্ধাবস্থায় আছে বিশ্বাস করে কোভিড পরীক্ষা এবং প্রাসঙ্গিক স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের কোভিড পেশেন্টদের কন্ট্যাক্ট-ট্রেসিংয়ের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এরপর সেই কন্ট্যাক্টদের ট্রেস করে আইসোলেট থাকতে বাধ্য করুন। হয় তারা সেলফ কোয়েরেন্টিনে থাকবে, আর তা সম্ভব না হলে আইসোলেশন হোস্টেল বানান। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের হলগুলোকে ব্যবহার কো যেতে পারে। সংক্রমিত লোকগুলোকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে তাদের তিনবেলা খাবার দিন, কোয়ারেন্টিন হোমকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

তুরস্কের পরিস্থিতি ২২ মার্চে। ছবি: সংগৃহীত
তুরস্কের পরিস্থিতি ২২ মার্চে। ছবি: সংগৃহীত

৫.
ডেটা সংগ্রহ করুন, বিভাগীয় আর কেন্দ্রীয়ভাবে ডেটা অ্যানালাইসিস করতে হবে। এতে কোথায় রোগীর সংখ্যা বেশি, ভেন্টিলেটার হাসপাতাল বেডের সংখ্যা কম আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

৬.
দেশের সব সীমান্ত সব বন্ধ করে দিতে হবে। যদিও সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। মানুষের আসা–যাওয়া আর সেই সঙ্গে রোগ ছড়ানো আপাতত সবকিছু কন্ট্রোলে রাখতে হবে।

৭.
দেশে সেনাসদস্যকে কোভিড–১৯ মোকাবিলায় নামান। তাদের দিয়ে দেশের প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ, রসদ সরবরাহের চেইনগুলো চালু রাখার জন্য নিয়ম আর নিরাপত্তা জরুরি জারি করা যেতে পারে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেন নিয়ন্ত্রিত থাকে, তার জন্য প্রশাসন মাঠে নামাতে হবে।

৮.
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতে হবে। গরিব যারা দিন আনে দিন খায়, তারা মারাত্মক অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে আছেন, তাদের পাশে দাঁড়ান, দরকার হলে লঙ্গরখানা খুলতে হবে। অনেকে কাজের অভাবে বাড়ি ভাড়া দিতে অক্ষম হবেন, সে ক্ষেত্রে আইন করে ভাড়াটেদের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে। সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ মানুষগুলোর প্রতিপালনে বেসরকারি খাত এবং এনজিওগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে কাজে নামাতে হবে।

৯.
প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর ইনিশিয়েটিভ অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের সব হাসপাতালকে কোভিড কেয়ারে জন্য অ্যাগ্রেসিভ ব্যবস্থা নিয়ে রেডি হতেই হবে। সেই সঙ্গে তাদের কোভিড টেস্টও করতে হবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, নাহলে সরাসরি চীনের সঙ্গে। চীনের ধনকুবের জ্যাকমা ফ্রি কোভিড টেস্ট কিট দিচ্ছেন, তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করা যেতে পারে। টেসলার ইলন মাস্কের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যেতে পারে। তার কোম্পানি এই দুর্যোগের সময়ে ভেন্টিলেটার সাপ্লাই দিচ্ছে।

১০.
ভেন্টিলেটার আর আক্সিজেন সাপ্লাইয়ের জন্য বাংলাদেশের মেশিনারিজ ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বুয়েটের অধ্যাপকদের অনুরোধ জানাব এ ব্যাপারে দেশীয় কোম্পনিগুলোর সঙ্গে সত্বর যোগাযোগ করুন। তাদের গাইড করুন।

১১.
দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে ওষুধ সাপ্লাই দিতে হবে।

সর্বশেষে সরকার থেকে শুরু করে দেশের সব মানুষকে এ ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হবে। এখন পর্যন্ত যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দাওয়াত দিচ্ছেন, দাওয়াত খাচ্ছেন, মসজিদ–মন্দিরে যাচ্ছেন, সমুদ্রসৈকতে গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এসব টোটালি বন্ধ করতে হবে।

*লেখক: প্রকৌশলী, আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস এনালিস্ট, যুক্তরাষ্ট্র