কোভিড-১৯ এবং আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মানসিকভাবে সবারই প্রচণ্ড চাপ যাচ্ছে গত কয়েক মাস। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারব কি না, হঠাৎ মরে গেলে এত ভালোবাসার পরিবারের কী হবে? কাজ নেই, টাকা-পয়সার টানাটানি, দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করব কীভাবে ইত্যাদি। ১০০ বছর পর আসা আগ্রাসী মহামারিতে এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে যাঁরা বেঁচে থাকবেন।

সবার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার চেষ্টা আলাদা। আমার টেকনিক ভালো বন্ধুদের সঙ্গে কষ্ট শেয়ার করা। দুঃখটা কমে। করোনা রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাঁরা কাজ করি, তাঁদের সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা। জুনিয়র এক ছেলেকে প্রায় কেঁদে ফেলতে দেখে বললাম, ‘মরতে তো সবাইকে হবে। সবার সময়ই অজানা কিন্তু নির্দিষ্ট, তাই না? প্লিজ মন ভালো করো। আমরা এতজন আছি, মাত্র অল্প কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়েছি।’ একটু হলেও স্বাভাবিক হয়েছে। আরেক অল্পবয়সী মেয়ে কলিগ কাঁদল সে দিন। একটা পজিটিভ রোগী যিনি মারা গেছেন, তাঁকে অনেকেই দেখেছি ওর মতো পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট ছাড়া। কারণ তাঁর উপসর্গ ছিল কনফিউশন, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট কিচ্ছু না। ওর ছোট বাচ্চা আছে, যার কাছ থেকে নিজেকে সে আলাদা রাখেনি। আমরা সঙ্গে সঙ্গে হালকা আলাপে চলে গেলাম, কোনো ইনফেকশাস ডিজিজের চিকিৎসকের কাজের চাপে ঘরের পোশাক পরে চলে এসেছিলেন ইত্যাদি। একটু স্বাভাবিক হতে বললাম, প্রায় ২ সপ্তাহ পার হয়েছে ওই ঘটনার পর। সবাই তো সুস্থ আছে, আছে না? তারপর পালা করে কিছুদিন তাকে সকাল-বিকাল সবাই খোঁজখবর নিয়ে ব্যস্ত রাখলাম। সেদিন দেখি সে আরেক নার্সকে খুব বোঝাচ্ছে, এসব বিপদ কেটে যাবে।

নিউইয়র্কে জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন সদ্য। মানুষের কষ্ট নিজ চোখে দেখা সোজা কথা না। কিন্তু আরও অনেক মানুষের সেবা করার জন্য নিজের বেঁচে থাকাটা কত জরুরি। চিকিৎসক বা নার্স বলে কথা না, যাঁরা অপরিহার্য কর্মী আছেন, সবার।

অনেকেই খাবার, পিপিই ডোনেট করছেন হাসপাতালে। মাঝেমধ্যে নার্সরা বিরক্ত হন, কারণ অভাবী মানুষকে দেওয়া উচিত আমাদের না দিয়ে। সেদিন বোঝালাম, নিজে ভালো থাকার জন্য অচেনা লোকজন এসব করছেন, প্রাণের ধন্যবাদটুকু দিতে আর লোকাল ছোট বিজনেসগুলো চালু রাখতে। নিজের ঘটনা বললাম তারপর। রেসিডেন্টটিতে ২৪ ঘণ্টা ডিউটির সময় সন্ধ্যা ৬টায় ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ হয়ে যেত। রাউন্ডে ভয়ে বলতে পারতাম না, ডিনার নিতে না পারলে উপবাস থাকতে হবে রাতে। অনেক দিন এমন হয়েছে, রাত ১২টার দিকে মায়াবতী কোনো নার্স তাঁর বাসা থেকে আনা খাবার শেয়ার করছেন। তারপর বললাম, তোমরাই তো বলো ‘পে ফরওয়ার্ড’। তোমরাও কমিউনিটিতে দাও। এভাবেই তো মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখছে সবাই।

ফেসবুক আমার ভালোবাসার একটা জায়গা। এ বিপর্যয়ে অনেকেই দেখছি মনকে দুশ্চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে রান্না করে দেখাচ্ছেন, পুরোনো নানা রঙের শাড়ি পরে ছবি দিচ্ছেন, ডোনেশান তুলে দেশে-বিদেশে গরিব মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছেন, আরও কত কী। সোশ্যাল আইসোলেশানে শিল্পীরা গান গেয়ে মাতিয়ে রাখছেন আমার মতো গানপাগল মানুষদের। সারা দিন কাজ করে যদি একটু ভুলে থাকতে চাই সবকিছু, তো গান শুনলাম বা গাইলাম।

লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) দেখছি করোনা মহামারির শুরুতে বাজার দিয়ে আসছেন বয়স্কদের। পবিত্র রমজান মাসের শুরুতেই ইফতারের দায়িত্ব নিয়েছেন লিস্ট করে বয়স্কদের। বাচ্চাদের ডেকে বললাম, ইবাদতের পাশাপাশি এমন সুন্দর চরিত্রের মানুষ হও তোমরা। মানসিক শান্তি আসবেই। একা একা ভালো থাকা যায় না। দান করার কথা বারবার বলা হয়েছে এমনি এমনি তো না। তারপর মেডিটেশন তো আছেই (নামাজ আমার মেডিটেশনের কাজ করে)।

তবু স্তব্ধ হলাম আমার চট্টগ্রাম মেডিকেলের সহপাঠী, তুখোড় স্ট্যান্ড করা ছাত্র সহকারী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান সজলের মৃত্যুতে। প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে কত দিন কতজনকে ভার্চ্যুয়াল উপদেশ সে দিয়েছে। কারও সাতে-পাঁচে না থাকা , ছোট্ট দুটা বাচ্চার বাবা যে করোনা মহামারির কারণে পরিবার থেকে আলাদা থাকত, লিফটের নিচে পড়ে থাকা সে সজলকে দেখে ভয়াবহ ধাক্কার মতো লাগল। কত ছোট জীবন আমাদের। চলে যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি ডাক আসে। কিন্তু যত দিন আছি একটু ভরসা হতে পারি সবার সজলের মতে। বেহেশতের বাগানে ফুল হয়ে থেকো বন্ধু। তোমার হাত থেকে খসে পড়া মোমবাতিটা আমাদের কেউ তুলে নিবে হয়তো কিন্তু দেশপ্রেমিক একজন প্রতিভাময় অকালে হারিয়েছি আমরা। এ ক্ষতি কখনো পূর্ণ হওয়ার না।