'কোভিড-১৯' সংকট ও সেরোলজিকাল টেস্টের গুরুত্ব

কোভিড-১৯ পৃথিবীর সব দেশেই নানা ধরণের সংকট তৈরী করেছে। পুরো পৃথিবীতে আজ হাসপাতাল ছাড়া প্রায় সব কিছুই অচল। নতুন গবেষণা অনুযায়ী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের শতকরা ২৫-৫০ ভাগের মধ্যে কোন প্রকার উপসর্গ থাকে না। অবশিষ্ট (৫০-৭৫%) যাদের মধ্যে উপসর্গ প্রকাশ পায় তাদের ৮০ ভাগ সামান্য উপসর্গ প্রকাশ করে, ১৪ ভাগ মাঝারি উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় (ভেন্টিলেশন সাপোর্টের জন্য) আর বাকি ৬ ভাগ ক্রিটিকাল যাদের দরকার পড়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট।

প্রথমত লম্বা সময় (২-১৪ দিন) এর ব্যবধানে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া আর দ্বিতীয়ত আক্রান্ত ব্যক্তিদের বড় অংশের কোনরকম উপসর্গ প্রকাশ না পাওয়া এ দুটি বিষয়ের কারনে ভাইরাসটি দ্বারা অনেক বেশি মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন।

লক্ষণ প্রকাশিত ব্যক্তিদের অনেকেই টেস্ট করাচ্ছেন না অথবা করাতে পারছেন না। আবার সংক্রমণ নির্নয়ের পদ্ধতির কিছু দূর্বলতা থাকতে পারে। সব মিলিয়ে কোভিড-১৯ -এ আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৭০% ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে (চিত্র ১)। সুতরাং, যে কোন দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সংক্রমিত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে সুস্থ ব্যক্তিদের থেকে তাদের আলাদা রাখা। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে প্রথম বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশও এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে।

করোনা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণের সম্ভাব্য বর্ণনাচিত্র। চিত্র কিছুটা অনুমান ভিত্তিক, প্রকৃত তথ্য এই মুহুর্তে জানা সম্ভব নয়। ছবি: লেখক
করোনা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণের সম্ভাব্য বর্ণনাচিত্র। চিত্র কিছুটা অনুমান ভিত্তিক, প্রকৃত তথ্য এই মুহুর্তে জানা সম্ভব নয়। ছবি: লেখক

বিশ্লেষকদের মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের চক্র দুই-তিন বছর দির্ঘায়িত হতে পারে। সংক্রমণ ঠেকাতে আমরাও লকডাউন পদ্ধতির অবলম্বন করেছি কিন্তু দেশের সব মানুষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন করে রাখাও সম্ভবপর নয়। আবার দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই যে, লকডাউন সরিয়ে নিলেই আমাদের মধ্যে ভাইরাসটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার ভয় রয়েছে, যা আমরা গত কয়েকদিনে বুঝতেও পেরেছি। এক্ষেত্রে একমাত্র যথাযথ এবং ব্যাপক পরিসরে টেস্টিং পারে কিছুটা স্বস্তি দিতে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ খুঁজে বের করতে আমরা যে পদ্ধতির নাম শুনে আসছি সেটি হলো রিয়েল-টাইম পিসিআর (real-time PCR)। এ পদ্ধতিতে রোগীর নমুনায় করোনাভাইরাসের আরএনএ (RNA) খোঁজ করা হয় এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এটি ব্যবহৃত হচ্ছে (চিত্র ২)।

তবে দ্বিতীয় আরেকটি পদ্ধতি হলো সেরোলজিকাল টেস্ট যার মাধ্যমে সংক্রমিত ব্যক্তির রক্তে করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডির উপস্থিতি খোঁজ করা হয় (চিত্র ২)। প্রথম পদ্ধতিটি যদিও বেশি গ্রহণযোগ্য তবে সেটার জন্য দরকার নির্দিষ্ট মানদন্ডের পরীক্ষাগার, দামি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ এবং দক্ষ পরীক্ষক। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি এক্ষত্রে খুবই সহজ এবং সুলভ কিন্তু সংক্রমিত ব্যক্তির রক্তে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরী হতে প্রায় ২-৩ সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়। সংক্রমিত ব্যক্তির রক্তে অবশ্য ভাইরাসের অ্যান্টিজেন পাওয়া যেতে পারে সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যেই। সুতরাং, রোগী সনাক্তকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে (২-১৪ দিন) অ্যান্টিবডি টেস্টের কোন গুরুত্ব না থাকলেও অ্যান্টিজেন টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পরীক্ষাগারে এনজাইম লিঙ্কড ইমিউনো সরবেন্ট অ্যাসে (ELISA) পদ্ধতিতে সেরোলজিকাল টেস্ট করা হয়। তবে রেপিড ডিটেকশন কিট দিয়েও এ ধরণের টেস্ট করা সম্ভব। যদিও একটি ভালো মানের কিট পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। সম্প্রতি এফডিএ (FDA) আমেরিকাতে করোনা ভাইরাসের জন্য র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি ডিটেকশন কিটের অনুমোদন দিয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সনাক্তকরনের বিভিন্ন পদ্ধতি। ছবি: লেখক
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সনাক্তকরনের বিভিন্ন পদ্ধতি। ছবি: লেখক

আপাত দৃষ্টিতে র‍্যাপিড ডিটেকশন কিটের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাই এটা নিয়ে বিতর্কের জন্ম নিয়েছে। তবে এর কার্যকারিতা বুঝবার জন্য প্রথমে ভাইরাসের গঠণ ও জীবন চক্র সম্পর্কে একটু ধারণা নিতে হবে। করোনা ভাইরসের বহিঃআবরণে S, M, এবং E এবং এর RNA -এর সাথে N প্রোটিণ পাওয়া যায়। ভাইরাসের S প্রোটিণ আমাদের দেহ কোষের ACE-2 রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। কোষের ভেতরে ভাইরাসের RNA উম্মোচিত হয়ে নতুন ভাইরাস প্রস্তুত করে (চিত্র ৩ক)। নতুন ভাইরাসগুলো বেরিয়ে এসে নতুন কোষকে আক্রমণ করে। এভাবেই ভাইরাস কোষদের ধ্বংস করে দেহের ক্ষতি সাধন করে। কিছু নভেল (১%) এ সময় রক্তের মাধ্যমে দেহের অন্যান্য কোষকে আক্রমণ করতে পারে। তবে রক্তে করোনাভাইরাস কম পাওয়া গেলেও প্রচুর পরিমাণে N প্রোটিন পাওয়া যায়। ভাইরাসকে প্রতিহত করতে দেহের ইমিউন সিস্টেম তার প্রতিরোধী কোষদের প্রস্তুত করে। বিশেষ ধরণের প্রতিরোধী কোষ ভাইরাসকে দমণ করার জন্য অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে (চিত্র ৩ খ)।

অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের প্রোটিণের (S, M, E এবং N ইত্যাদি) বিপরীতে তৈরী হয়। একজন আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্রথম ১৪ দিন অর্থাৎ লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাস (১%) বা N প্রোটিন পাওয়া যেতে পারে। লক্ষণ প্রকাশের ৭ দিনের মধ্যে IgM অ্যান্টিবডি পাওয়া যায় যা প্রায় ১৪ দিন পর্যন্ত থাকে। এ সময় রক্তে ভাইরাস বা N প্রোটিনের পরিমাণ হ্রাস পেতে শুরু করে এবং সাধারণত ১৪ দিনের মাথায় তাদের আর পাওয়া যায় না। যখন IgM অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমতে শুরু করে তখন IgG অ্যান্টিবডির আবির্ভাব ঘটে যেটা লম্বা সময় দেহে প্রতিরক্ষা প্রদাণ করে (চিত্র ৩ গ)। সার্স ভাইরাসের উপর গবেষণা অনুযায়ী রক্তে প্রায় তিন বছর পর্যন্ত প্রতিরক্ষা অ্যান্টিবডি কার্যকরী পরিমাণে থাকা সম্ভব।

করোনাভাইরাসের জীবন চক্র বনাম দেহে অ্যান্টিবডি প্রস্তুতি। ছবি: লেখক
করোনাভাইরাসের জীবন চক্র বনাম দেহে অ্যান্টিবডি প্রস্তুতি। ছবি: লেখক

গত কয়েক মাসে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি সুস্থ্য হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো টেস্টে পজিটিভ (যেটি হওয়ার কথা নয়) আবার কয়েকটি খবর বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত হয়েছে, এর অর্থ হলো মাঝের নেগেটিভ পিসিআর টেস্টের ফলাফলটি ভুল ছিল। যদিও রিয়েল-টাইম পিসিআর পদ্ধতিকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়, অনেক সময় নমুনা সংগ্রহের সময় রোগীর দেহে স্বল্প পরিমাণে ভাইরাস থাকার দরুন অথবা মধ্যবর্তী কোন ধাপে ভুল হওয়ার জন্য টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে। ঠিক এই জায়গায় একটি সেরোলজিকাল টেস্ট ভুমিকা রাখতে পারে। একজন ব্যক্তি কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হবার পর তার শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে করোনার অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়। সম্প্রতি এফডিএ (FDA) আমেরিকাতে কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা মানুষের প্লাজমা অ্যান্টিবডি দিয়ে অন্য কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা বাংলাদেশী করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স পেতে শুরু করেছি তবে এপর্যন্ত ভাইরাসটির জিনগত পরিবর্তনের হার খুবই সামান্য। তার মানে একটি ভ্যাকসিন যদি আমরা তাড়াতাড়ি পেতে পারি সেটি আমাদের ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। যদিও ভ্যাক্সিনের কথা বলছি আমরা জানি আগামী দু-এক বছরের আগে একটি সফল ভ্যাক্সিন পাওয়া অসম্ভব। সুতরাং, আমাদের নির্ভর করতে হবে বিভিন্ন অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ ও কম্বিনেশন থেরাপির ওপরে।

সারা বিশ্ব করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যেটির অপেক্ষায় সেটি হল হার্ড ইমিউনিটি। এ ধরনের ইমিউনিটি আসতে পারে গণহারে ইনফেকশন অথবা ভ্যাক্সিনেশনের দ্বারা। যেকোনো ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য থাকে জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি সৃষ্টি। অর্থাৎ একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে যদি বেশিরভাগ মানুষ (৫০-৭০%) একটি নির্দিষ্ট জীবাণুর বিপরীতে ইমিউনিটি লাভ করে তাহলে বাকিদের মধ্যে জীবাণুটি আর ছড়াতে পারবে না। যেহেতু সফল ভ্যাক্সিন আসতে বেশ লম্বা সময় প্রয়োজন সেহেতু শুনতে খারাপ লাগলেও বিশ্বের অনেক দেশই এই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে চেয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংক্রমণ দ্বারা। এ ধরণের পন্থা অবশ্যই দেশের স্বাস্থ্যখাতে সংকট তৈরী করবে কিন্তু যে দেশ যতো আগে এই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারবে সে দেশে ততো দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। ঠিক এই জায়গায় সেরোলজিকাল টেস্ট খুব সহজেই দেখিয়ে দিতে পারবে সুস্থ্য হয়ে ওঠার পরে একজন মানুষের দেহে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি।

মোটা দাগে বলা যায় কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত ব্যক্তিদের অধিকাংশই সাধারণভাবে চলাফেরা করছেন হয়তো উপসর্গহীনভাবে অথবা সামান্য উপসর্গ নিয়ে। এমনও হতে পারে আপনি আমি বা আমাদের আশেপাশের অনেকেই ইতোমধ্যে সংক্রমিত হয়ে সুস্থ্যও হয়ে গিয়েছের নিজের অজান্তেই। এরপরও করোনা জুজুর ভয়ে অযাথাই নিজেদের লকডাউন করে রেখেছি! আমাদের মাথায় রাখতে হবে সহসাই এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। আর একমাত্র ইমিউনিটির পাসপোর্ট আমাদের মুক্তি দিতে পারে, দেশকে করতে পারে গতিশীল। আশা করছি সরকার রিয়েল-টাইম পিসিআর এর পাশাপাশি সেরোলজিকাল টেস্টকেও করোনাভাইরাস দমনের কার্যকরী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবেন।

*লেখক: পিএইচডি ইন ভাইরোলজি, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য ও

সহযোগী অধ্যাপক মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]