স্বাস্থ্যসেবা: যাহা চাই ভুল করে চাই

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিদের চোখে উপনিষদের একজন ঋষি ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বিদেশে, রবীন্দ্রনাথকে একজন আধ্যাত্মিক কবি হিসেবে ধরা হয়। তাঁর যে রচনাকর্ম, তাঁর জীবন, নিজের সময়ে নিজের ভূমিকা খোঁজার চেষ্টা এবং সেই অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা—সব ক্ষেত্রেই তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা বা ঈশ্বরচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

যাহা চাই ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না—বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি’ কবিতা থেকে নেওয়া। রবীন্দ্রনাথের এই কথায় রয়েছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। পাওয়া না–পাওয়ার হতাশা। চাওয়ার সঙ্গে না পাওয়ার অসামঞ্জস্যতা। এটি একধরনের মানবমনের অস্থিরতারই প্রকাশ। এককথায় হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীনতার বহিঃপ্রকাশ।

কিন্তু কোনো সিস্টেম বা প্রতিষ্ঠান এভাবে চলে না। এখানে অস্থিরতা থাকে না। নিয়মকানুন হতে হয় ইস্পাতসম। দোদুল্যমনা, টেকসইহীন হলে সেটি বেশি দিন চলে না। মানুষের আস্থা থাকে না। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের এই ভঙ্গুর দশা দেখতে পাব। তবে আপাতত, কোভিড-১৯ সংকটে স্বাস্থ্য খাত কি সেই বার্তা মাথা উঁচু করে জানান দিচ্ছে?

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয় (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়োগ–সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি তারই সর্বশেষ উদাহরণ। সেখানে নবম গ্রেড, সহকারী জীবাণুবিদ পদের জন্য ফার্মেসি, বায়োকেমিস্ট্রি, ভেটেরিনারি সায়েন্সসহ কেমিস্ট্রি ও অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি ও চাওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে প্রকৃতপক্ষে আসল অণুজীববিদ (জীবাণুবিদ) চাওয়া হয়নি। আমি নিশ্চিত, তাদের এমন বিজ্ঞপ্তি দেখে, যাদের চাওয়া হয়েছে বিশেষ করে কেমিস্ট্রি ও অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রির লোকজনও বিব্রত হবেন। কারণ, তাদের জীবাণু নিয়ে কোন কিছুই জানার কথা না। তাঁদের ছোট করছি না। মাইক্রোবায়োলজিস্টদের (অণুজীববিদ) ও যদি কেমিস্ট্রি ফিল্ডে চাকরি করতে বলেন, রসায়ন বাদ দিয়ে, তাহলে মাইক্রোবায়োলজিস্টরা লজ্জা পাবেন কোনো সন্দেহ নেই। এটা তখনই হতে পারে, যদি না কোনো ফিল্ডে কাউকে পাওয়া না যায়। সে ক্ষেত্রে অন্য ফিল্ড থেকে নিয়ে আসতে হয় বিশেষ বিবেচনা সাপেক্ষে।

অথচ জীবাণু নিয়ে চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যা থেকে প্রতিবছর গ্র্যাজুয়েট বের হন প্রায় এক হাজার। তাঁরা আবেদন করার যোগ্য হলেন না।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে ২০ জনকে মলিকুলার বায়োলজিস্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে একজনও পিওর (আসল) অণুজীববিদদের নেওয়া হয়নি। এসব সিদ্ধান্ত শুধু অদূরদর্শিতা নয়, স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর দশারই প্রতিচ্ছবি।

যথাযথভাবেই মাইক্রোবায়োলজিস্টদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্ট (বিএসএম), গ্র্যাজুয়েট মাইক্রোবায়োলিজিস্ট সোসাইটি (জিএমএস) বাংলাদেশ ও বায়োটেকনোলজিস্টদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েট (বিএবিজি), এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ বাতিল চেয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় (যেমন প্রথম আলো ১৫ জুন, ২০২০) বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার হয়েছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জীবাণুবিদদের সমন্বয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। যার মাধ্যমে শুধু এই সংকট থেকে মুক্তিই না, পরবর্তী সময়েও স্বাস্থ্য খাতে জনমানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে মনে করে।

কোভিড-১৯ সংকটে মোরালিটি ধরে রাখা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যাঁরা সম্মুখ সারিতে কাজ করছেন। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের পাশাপাশি, নার্স, টেকনোলজিস্টরা ও মহান দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের কাছে জাতি কৃতজ্ঞ। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তাঁদের সঙ্গে মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, বায়োকেমিস্টরাও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাইরাস শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন পরিবার–পরিজনকে ঘরে রেখে। তাঁদের কোনো প্রণোদনা নেই, সর্বোচ্চ যোগ্যতা থাকার পরও নিয়োগ নেই। যাঁদের সম্পর্কিত বিষয়ে দখল অপেক্ষাকৃত কম বা একেবারেই নেই তাদেরও অগ্রাধিকার আছে। এমন বৈষম্য ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন না করলে মোরালিটি ধরে রাখা সত্যিই কঠিন। এটি স্বাস্থ্য খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আরেকবার মনে করতে হয়, বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।

আমাদের কোথাও যেন জড়তা, সমন্বয়ের চরম অভাব লক্ষণীয়। এ রকম সংকটগুলোতে সেসব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যেসব খাতের বেহাল দশা, কোনোমতে কসমেটিকস দিয়ে টিকে আছে, তারা চাপ নিতে পারে না। চাপের সময় কসমেটিকস কাজ করে না। তার আসল কঙ্কাল বের হয়ে আসে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো সেসব কসমেটিকসে বিশ্বাস করে না। উদাহরণস্বরূপ, কানাডাতে কোভিড-১৯ সংকট শুরু হয় মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে। যাঁরা নার্সিংয়ে স্নাতক করছিলেন, তাঁদের ডিগ্রি শেষ হওয়ার কথা ছিল মে মাসে। এই সংকটে ডিগ্রি শেষ হওয়ার আগেই, মার্চেই তাঁদের ডিগ্রি দিয়ে কাজে নামানে হয়। তাঁরা জানতেন তাঁদের দক্ষতা ও যোগ্যতা। তাঁদের কঙ্কাল কত শক্ত, তা একনজরে বলে দেওয়া যায়। সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা দ্বিধা করেননি। যেখানে যাঁদের থাকার কথা, সেখানেই তাঁদের রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তারা যাহা চাই, ভুল করে চাই, এমন করে না। অথচ, আমাদের লোক আছে, ল্যাব আছে, যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাবে কোভিড-১৯ টেস্টিং বন্ধ থাকে।

স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সম্যক ধারণা না থাকার সঙ্গে যদি সদিচ্ছার অভাব যোগ হয় তাহলে, ‘যাহা চাই ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না’–এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। এত কিছু অল্প সময়ে সমাধান করা যায় না সত্যি। কিন্তু সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় দেন, অল্প সময়ে অনেক কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এমন লোক আছে। শুধু দরকার সরকারের উচ্চপর্যায়ের সদিচ্ছা।

*পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা। [email protected]