সরকারি চার ব্যাংকে খেলাপি ঋণে রেকর্ড

.
.

রাষ্ট্রমালিকানাধীন চারটি ব্যাংক খেলাপি ঋণে নতুন একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। মাত্র এক বছরেই তাদের সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে গেছে।

এ সময় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে জনতা ব্যাংকে। এরপরই রয়েছে অগ্রণী, সোনালী ও রূপালী ব্যাংক। এতে করে ২০১৬ সাল শেষে ব্যাংক চারটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। আর লোকসান গুনছে এমন শাখা বেড়ে হয়েছে ৪৪৬। চার ব্যাংকের নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলোকে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বাছবিচার ছাড়া তদবিরে প্রভাবশালীদের দেওয়া হচ্ছে ঋণ। আরও রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির অভাব। এসব কারণেই সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা ধ্বংসের মুখে। এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক মইনুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এখনো নতুন ঋণ দিয়ে পুরোনো খারাপ ঋণ ভালো করা হচ্ছে। ব্যাংকের এই পুরোনো রোগটা সারাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার। যেটা সরকারের নেই, আগের সরকারেরও ছিল না। ঋণখেলাপিদের কোনো বিচার হচ্ছে না, দেউলিয়া আদালত অকার্যকর। এ কারণে ঋণখেলাপিরা সাহস পাচ্ছে।

ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, আগের পুনঃ তফসিল করা ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। এসব ঋণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ সুবিধা দিয়ে নিয়মিত করা হলেও তা ঠিক রাখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সরকারি তিন ব্যাংকের আগের এমডি কোনোভাবেই ভালো ছিলেন না। তাঁরাই এসব ঋণ দিয়েছেন। এরপরই জেনেশুনে সরকার তাঁদের মেয়াদ বাড়িয়ে ছয় বছর পর্যন্ত দায়িত্বে রেখেছিলেন। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দায়ী।

সোনালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন প্রদীপ কুমার দত্ত, রূপালী ব্যাংকের এম ফরিদ উদ্দিন ও অগ্রণী ব্যাংকের সৈয়দ আবদুল হামিদ। এর মধ্যে আবদুল হামিদকে মেয়াদ শেষ হওয়ার শেষ দিনে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় তিনি দীর্ঘদিন পলাতকও ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সানুগ্রহ পেয়ে অপর দুই এমডিও পদে ছিলেন দীর্ঘদিন।

সোনালী ব্যাংক

নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে আদায়, সুদ মওকুফ এবং ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছিল ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে নতুন করে ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে।

এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আগে আদালতের রিট থাকা ঋণগুলো নিয়মিত দেখানো হতো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে তা খেলাপি দেখানো হচ্ছে। এর ফলে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ ছাড়া আগে নিয়মিত করা প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ঋণ এবং নতুন করে আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংক

অগ্রণী ব্যাংকে ২০১৬ সালে আদায়, সুদ মওকুফ, পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমেছিল ৯৫৩ কোটি টাকা। তবে নতুন করে ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক গুণগত মানের ভিত্তিতে অগ্রণী ব্যাংকের ৬২২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করে দিয়েছে। বহিঃনিরীক্ষক আরও ৩০৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করেছে। এ ছাড়া আরও কয়েকজন বড় গ্রাহকও খেলাপি হয়ে পড়েছে।

অগ্রণী ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বছরে অ্যাডভান্স কম্পোজিটের ১৪৮ কোটি টাকা, জাকিয়া কটনের ১১৬ কোটি টাকা, সুরুজ মিয়া গ্রুপের ৫০ কোটি, ইফতি ফ্যাশনের ৫০ কোটি, এম আর সোয়েটারের ১১০ কোটি, জুলিয়া সোয়েটারের ৮৫ কোটি, অ্যারিস্ট্রকেটের ১১০ কোটি, মারহাবা স্পিনিংয়ের ১২১ কোটি, সাদ মুসা গ্রুপের ৯০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের কয়েকজন গ্রাহক গত বছর খেলাপি হয়ে পড়ে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বহিঃনিরীক্ষকও বেশ কিছু ঋণ খেলাপি করে দিয়েছে। এতে করে গত বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু ঋণ নিয়মিত করা গেছে।

জনতা ব্যাংক

জনতা ব্যাংকে গত বছরে খেলাপি থেকে আদায় হয়েছে ৬৪০ কোটি টাকা, অবলোপন করা হয় ১৫১ কোটি টাকা, সুদ মওকুফ করা হয় সাড়ে ৩ কোটি টাকা এবং পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করা হয় ৯২৪ কোটি টাকা। এতে খেলাপি ঋণ কমে এলেও গত বছরে নতুন করে ৩ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে।

ব্যাংকটির একটি সূত্র বলছে, ২০১৫ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড ও ইব্রাহীম টেক্সটাইলের ঋণ নিয়মিত থাকলেও গত বছর তা খেলাপি হয়ে পড়ে। এতে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া পুনর্গঠন করা কয়েকটি ঋণও আদায় হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক গুণগত মানে কিছু ঋণ খেলাপি করে দিয়েছে। এ ছাড়া অন্য ব্যাংক থেকে আনা কয়েকটি বড় ঋণও গত বছর খেলাপি হয়েছে। ফলে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আমরা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’

রূপালী ব্যাংক

২০১৬ সালে ব্যাংকটির নতুন করে ২ হাজার ৯৮ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংক সূত্র বলছে, নুরজাহান গ্রুপের ৯৪৪ কোটি টাকা ঋণ গত বছর খেলাপিতে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা ট্রেডিংয়ের ৯২ কোটি, প্রাইস ক্লাবের ৭২ কোটি, শীতল স্টিলের ৫২ কোটি ও ক্রিস্টাল শিপ ব্রেকার্সের ৫২ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে গেছে।

রূপালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বড় কয়েকটি ঋণ আদালতের আদেশ নিয়ে খেলাপি থেকে বাইরে ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে তা খেলাপিতে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে অনেকে খেলাপি হয়ে গেছে। এতে খেলাপি বেড়ে গেছে।

এদিকে ঋণখেলাপি বাড়ায় মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে ব্যাংকগুলো। এ কারণে গত তিন বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোতে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছে। আর এই অর্থ দেওয়া হয়েছে জনগণের করের টাকা দিয়ে।

সামগ্রিক এ বিষয় নিয়ে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অবলোপন করে ব্যাংকগুলো প্রকৃত ঋণ লুকিয়ে রাখছে। গত ১৫ বছরে অবলোপন করা ঋণের ৫ শতাংশও আদায় হয়নি। এক পরিবার থেকে ৪ পরিচালক ও ৯ বছর মেয়াদ দিয়ে নতুন আইন করার উদ্যোগের কারণে সরকার ঋণখেলাপিদের সক্রিয় সহযোগী হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

২০১৬ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এর বাইরে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এসব মন্দ ঋণ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এ ঋণ হিসেবে এলে খেলাপি ঋণ হতো ১ লাখ কোটি টাকার বেশি।