কর আদায়ে সাংঘাতিক রকমের দুর্বলতা আছে

>

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রথমবারের মতো দেশের যে ৮৪ পরিবারকে ‘কর বাহাদুর পরিবার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তার মধ্যে একটি বগুড়ার মতিয়ার রহমানের পরিবার। কর বাহাদুর পরিবার স্বীকৃতির বাইরেও সেরা নারী করদাতা হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন মতিয়ার রহমানের মেয়ে মেহতাজ তাসনিয়া। ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিত কর দিচ্ছেন মতিয়ার রহমান। ১৯৯০ সাল থেকে কর দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী দিলরুবা বেগম। আর দুই কন্যার মধ্যে একজন ২৩ বছর ধরে এবং অন্যজন ২১ বছর ধরে নিয়মিত কর দিচ্ছেন।  ষাটের দশকে যন্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক পাস করা মতিয়ার রহমান একসময় চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে সত্তরের দশকে পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যে। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। পরে যুক্ত হন ইটভাটা, ফাউন্ড্রি ও হালকা প্রকৌশল ব্যবসার সঙ্গে। দেশের কর আদায় আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, কীভাবে কর আদায়পদ্ধতি সহজ করা যায় এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মতিয়ার রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার পারভেজ

মেয়ে মেহতাজ তাসনিয়ার সঙ্গে মতিয়ার রহমান
মেয়ে মেহতাজ তাসনিয়ার সঙ্গে মতিয়ার রহমান


প্রথম আলো: কখন থেকে কর দেওয়া শুরু করলেন। নিজে এবং পরিবার মিলে কী পরিমাণ কর দেন?

মতিয়ার রহমান: প্রবাস থেকে দেশে ফিরে সেনানিবাসে নির্মাণ ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেছিলাম। সেনাবাহিনীর কাজে বিল প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার সঙ্গে কর প্রদানের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হতো। এ কারণে ব্যবসা শুরুর দিক থেকেই কর প্রদানে উৎসাহিত বোধ করতাম। মনে মনে ভাবতাম, কর না দিলে দেশ সামনে এগিয়ে যাবে কেমনে? সেই থেকে শুরু। এখনো স্বেচ্ছায় স্বচ্ছতার সঙ্গে কর দিয়ে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যদের যেদিন থেকে ব্যবসায় অংশীদার করেছি সেদিন থেকে তাদেরও কর প্রদানে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। এখন নিজে ও পরিবার মিলে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার কর দিই। কর বাহাদুর সম্মাননার আগে ২০১৫ সালে উৎপাদন পর্যায়ে জেলায় সর্বোচ্চ ভ্যাটদাতা হয়েছিলাম।

প্রথম আলো: কর দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে কি?

মতিয়ার রহমান: বাংলাদেশে কর আদায়ে পদ্ধতিগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন কর প্রদানে উৎসাহ বাড়াতে কর মেলা, উদ্বুদ্ধকরণ সভাসহ নানা কিছুর আয়োজন করা হয়। সেই অর্থে হয়রানি-ভোগান্তি কিছুটা কমেছে। কিন্তু কর প্রদানের জন্য রিটার্ন ফরম এখনো অনেক জটিল। এসব জটিলতা নিরসন করে কর প্রদানব্যবস্থা আরও সহজ করা দরকার।

প্রথম আলো: এখনো দেশের বিপুলসংখ্যক লোক কর দেন না। কর ফাঁকির সংস্কৃতিকে কীভাবে দেখেন?

মতিয়ার রহমান: আসলে ব্যবসা-চাকরি, বিনিয়োগ যা কিছুই করি না কেন প্রত্যেক মানুষের ভেতরে দেশপ্রেমটা থাকতে হবে। দেশপ্রেমের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। একজন নাগরিকের ভেতর দেশপ্রেমের চেতনা থাকলে কর ফাঁকি তার মাথায় আসবে না। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই স্বচ্ছতার সঙ্গে কর প্রদানে উৎসাহিত হবে। তবে শুধু কর প্রদানকারীর ভেতরে দেশপ্রেম থাকলে হবে না, কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ভেতরেও দেশপ্রেমের চেতনা এবং স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

প্রথম আলো: কর প্রদানে মানুষ আগ্রহী হচ্ছে না কেন?

মতিয়ার রহমান: বাংলাদেশের কর আদায়ে এখনো সাংঘাতিক রকমের দুর্বলতা আছে। এখনো বিপুল জনগোষ্ঠী করের আওতার বাইরে রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ব্যবসার ক্ষেত্রে কর ফাঁকি দিয়ে সাফল্য পাওয়া সম্ভব, কিন্তু সেই সাফল্যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া সম্ভব নয়। কর প্রদানের সংস্কৃতিটা তৈরি হতে হবে ঘরে ঘরে। বিন্দু বিন্দু করের টাকায় জমানো সিন্ধু দিয়ে উন্নয়ন-অগ্রগতির মাধ্যমে দেশকে মধ্যম
আয়ের দেশে রূপান্তর করা সম্ভব। কর প্রদানের সংস্কৃতিটা তৈরি হওয়া জরুরি পরিবার থেকেই। এ কারণে আমি নিজে শুধু কর দিই না, স্ত্রী-কন্যাদেরও কর প্রদানে উৎসাহিত করি। কর বাহাদুর সম্মাননা পেয়ে পরিবারের সদস্যরা গর্বিত। এটা সরকারের অনবদ্য উদ্যোগ। এর ফলে মানুষের মাঝে কর প্রদানের প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। ব্যক্তিগতভাবে কর প্রদানে আমি উৎসাহবোধ করি।

প্রথম আলো: দীর্ঘদিন ধরে কর প্রদানের বিপরীতে কোনো সুবিধা পাচ্ছেন কি?

মতিয়ার রহমান: আমার কাছে ব্যবসায় সাফল্যের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বচ্ছতা। আর স্বচ্ছতার পূর্বশর্ত যথাযথ কর প্রদান। কর ফাঁকি দিয়ে ব্যবসায়িক সুনাম, যশ, খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। ব্যবসা ও শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ করতে অনেক সময় ঋণের জন্য ব্যাংকে যেতে হয়। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ঋণ নিতে ব্যবসার পরিধি প্রমাণ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে কর প্রদানের নথি দিয়েই ব্যাংকের কাছে ব্যবসার পরিধি প্রমাণ করা সম্ভব। কর প্রদানের প্রত্যক্ষ সুবিধা সেই অর্থে পাইনি। তবে এটি আমার ব্যবসার সুনাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রথম আলো: এখনো দেশের বিপুলসংখ্যক লোক কেন কর দেন না বলে মনে করেন? কর আদায় বাড়াতে কী করা দরকার?

মতিয়ার রহমান: বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো করের আওতার বাইরে এটা ঠিক, তবে ধীরে ধীরে কর আদায়ের পরিমাণ অনেক বাড়ছে। কর কী, করের অর্থ কীসে ব্যয় হয়, কেন দিতে হবে, এ বিষয়টি এখনো অনেকের অজানা। কর সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কর প্রদানকে পারিবারিক সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি। কর সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে ধারণা দিতে পাঠ্যসূচিতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। কর প্রদানকারীদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কর আদায়কারী ও প্রদানকারীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা বাড়ানো জরুরি। পরিবহন খাত থেকে নামে-বেনামে নানা খাতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ চাঁদা তোলা হয়। এসব অর্থেরও কর প্রদান করা দরকার। কর প্রদানে উৎসাহ প্রদান করতে প্রত্যেক পেশাজীবী থেকে সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রবর্তন করা যেতে পারে।

প্রথম আলো: কর আদায় বৃদ্ধির সুফল অন্যরা কীভাবে পেতে পারে?

মতিয়ার রহমান: কর আদায় যত বাড়বে, যাঁরা নিয়মিত কর দেন তাঁদের ওপর করের চাপ তত কমবে। প্রত্যেক অর্থবছরে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সফল করতে সর্বোচ্চ করদাতাদের ওপর বেশি করে চাপ দেওয়া হয়। সবাই কর দিলে নিয়মিত করদাতাদের ওপর চাপ কম পড়বে।

প্রথম আলো: সর্বোচ্চ করদাতা পরিবারপ্রধান হিসেবে সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী?

 মতিয়ার রহমান: বৈধ-অবৈধ সব ধরনের আয় থেকে সরকার কর আদায় নিশ্চিত করুক, করের টাকায় দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা  অব্যাহত থাকুক এটাই প্রত্যাশা।

প্রথম আলো: বগুড়ায় শিল্প-বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক অবস্থা কেমন?

মতিয়ার রহমান: প্রাচীন শিল্পশহর ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্যবাহী জেলা বগুড়ায় দীর্ঘদিন পর শিল্প জেগে উঠেছে। বেসরকারি উদ্যোগে নানামুখী শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরও সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে আরও নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠবে। তবে বগুড়ার শিল্পপ্রাণ খ্যাত ফাউন্ড্রি খাত ধীরে ধীরে জৌলুশ হারাচ্ছে। এ শিল্পের কাঁচামাল পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এতে পণ্য উৎপাদনে খরচ অনেক বেড়ে যায়। অথচ এর চেয়ে অনেক কম দামে চীনসহ কয়েকটি দেশ থেকে পণ্য এনে কম দামে তা বাজারজাত হচ্ছে। এতে মুখ থুবড়ে পড়ছে দেশীয় ফাউন্ড্রি শিল্প। আবার পিভিসি পাইপ, সিরামিকস, পাটকলসহ নানা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়লেও পাইপলাইনের গ্যাস-সংযোগ মিলছে না। অন্যদিকে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে বগুড়ার ব্যাপক গুরুত্ব থাকলেও এখানে আকাশপথে যোগাযোগ-সুবিধা না থাকায় অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। বগুড়ায় বিমানবন্দর চালু, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ এবং ঢাকা-বগুড়া চার লেনের সড়কপথ নিশ্চিত করা গেলে এখানে বিনিয়োগ আরও অনেক বাড়বে।