গরিব দেশের বদনাম ঘুচল

>
  • বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। 
  • জাতিসংঘের হিসাবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে টিকবে কি না, তা নিয়ে স্বাধীনতার পরপরই আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তাই সে সময় বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এসে দেশের অর্থনীতির অবয়বই পাল্টে গেছে। ফলে গরিব দেশের তালিকা থেকে পুরোপুরি বের হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে।

বড় সুখবর হলো ২০১৮ সালেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। আর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতার পর অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই দুটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন। এ দুটি অর্জন এসেছে যথাক্রমে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক থেকে।

আশির দশকে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ থেকে ৪ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর দুটি বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এই দুটি হলো অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে তা মানবসম্পদে রূপান্তর। তিনি বলেন, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। আবার সনাতনী কৃষি খাতকে আধুনিক করে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে দেশ। অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ করে জনসংখ্যার বোঝাকে জনসম্পদে পরিণত করা হয়েছে। এগুলোর সুফল পাচ্ছে অর্থনীতি।

উত্তরণ

স্বল্পোন্নত ও নিম্ন আয়ের দেশ—এ দুটি আসলে গরিব দেশের নির্দেশক। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। আর স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর মানে গরিব দেশের বদনাম ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হতে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এই যোগ্যতা অর্জনের সংবাদ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিনটি সূচকের দুটিতে নির্ধারিত মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করে স্বল্পোন্নত দেশ। বাংলাদেশ এবার সবগুলোতেই পাস করেছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের ঘটনা সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্‌যাপন করছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় অর্জন। অবশ্য উন্নয়নশীল দেশ হতে আরও ছয় বছর সময় লাগবে।

এর আগে ২০১৫ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে যে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার অতিক্রম করলে সেই দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ ওই বছর এই সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার। অবশ্য বিশ্বব্যাংক অ্যাটলাস পদ্ধতিতে মাথাপিছু আয় হিসাব করে, সেখানে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করা হয়। মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ১২৫ ডলার অতিক্রম করলে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে ঢুকে যাবে বাংলাদেশ। আর ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার অতিক্রম করলে হবে উচ্চ আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫০ থেকে ৭০ ডলার। সেটি এখন দেড় হাজার ডলার ছাড়িয়েছে।

কৃষি থেকে সেবা

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা করেছিল বিশ্বব্যাংক ১৯৭২ সালে। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সেবা খাতনির্ভর। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৫৪ শতাংশই আসে সেবা খাত থেকে।

পাট থেকে পোশাক

মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে অর্থনীতিতে প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট। সেই পাটের জায়গায় এখন তৈরি পোশাক এসেছে। তবে এক পণ্য নির্ভর রপ্তানি খাতের চিত্র পাল্টায়নি। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত গড়ে বছরে ৪২ কোটি ডলার পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল গড়ে প্রায় ২৭ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির ৬৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৩ হাজার ৪৮৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাকের অবদান প্রায় ৮১ শতাংশ।

বৈষম্য বেড়েছে

বিবিএসের সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করেন ধনী ১০ শতাংশ মানুষ। আর মাত্র ১ শতাংশ আয় করে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৎকালীন বাংলাদেশের তুলনামূলক ধনী ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কাছেই দেশের মোট আয়ের ৪৬ শতাংশ যায়। আর ২৫ শতাংশ মানুষের কাছে যায় মাত্র ৭ শতাংশ।