ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে লোকসানে ফারমার্স

• টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা
• আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি
• সিদ্ধান্ত হলেও তিন মাসেও মূলধন জোগান হয়নি
• সংকটের প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে


সংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি হওয়ায় ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংকটির শাখাগুলোতে প্রতিদিন ভিড় করেও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। অন্যদিকে নানা অনিয়ম করে দেওয়া ঋণও আদায় করতে পারছে না তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া ফারমার্স ব্যাংকের অনিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এসব গুরুতর আর্থিক তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে নতুন করে ব্যাংকটির আরও যেসব আর্থিক অনিয়ম বেরিয়ে আসছে, তা হিসাবে নিলে লোকসান বাড়বে কয়েক গুণ। বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি ফেরত না আসার আশঙ্কা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করা হয়েছে মূলত মতিঝিল ও গুলশান শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার ঋণ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ও গুলশান শাখার ঋণ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর সময়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ‘ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের ভাগ নিয়েছেন তাঁরা। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।’ মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি।

এদিকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারার বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে। আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অন্য ব্যাংক থেকে আমানত তোলার প্রবণতা বাড়ায় ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট দেখা দিয়েছে। বেড়ে গেছে সুদের হার। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রমেও একধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতে পড়েছে। এত বড় দুরবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে ভালো প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। এ থেকে যে টাকা আসবে, তা গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া যেতে পারে। এ প্রক্রিয়া সফল না হলে ব্যাংকটি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

যোগাযোগ করা হলে ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু প্রথম আলোকে বলেন, ঋণের মান খারাপ হওয়ায় লোকসান হয়েছে। ব্যাংকটি যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এ জন্য কাজ চলছে। চলতি মাসের মধ্যে নতুন মূলধন জোগানের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এরপর ব্যাংকটিতে বিভিন্ন পরিবর্তন এনে নতুন করে যাত্রা করবে।

এহসান খসরু আরও জানান, সংকটে পড়ার পর গ্রাহকদের ২৬০ কোটি টাকা আমানত ফেরত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন আমানত এসেছে ৬০ কোটি ও ঋণ আদায় হয়েছে ২১০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, তারল্যসংকটে পড়ায় এখন নতুন করে মূলধন জোগান দিয়ে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সরকার। এ জন্য সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) উদ্যোগে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক থেকে মূলধন সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংকগুলোর কেউ বাড়তি ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এ জন্য ব্যাংকগুলো মূলধন জোগান দেওয়ার পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদে বসতে চাইছে। তবে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ তা মানতে কিছুটা দোটানায় রয়েছে। এ কারণে গত জানুয়ারিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।

৮ মার্চ প্রাক্-বাজেট আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের নামে লিখে দিতে হবে। ওই পরিমাণ শেয়ার লিখে দিলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে টাকা দেওয়া হবে। এ সময় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আলোচনায় পরামর্শ এসেছিল যে লেট দেম ডাই। ফারমার্স ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংককে কলাপস হতে দেব না। যেকোনোভাবেই একে রক্ষা করতে হবে।’

যোগাযোগ করা হলে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। কী প্রক্রিয়ায় ফারমার্স ব্যাংককে সহায়তা করা হবে, তার সিদ্ধান্ত এলেই মূলধন দেওয়া হবে।’

ফারমার্স ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে যাত্রার পর ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে মুনাফা হয় ৩ কোটি, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ও ২০১৬ সালে ২৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭ সালে এসে লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। বিতরণ করা ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭২৩ কোটি টাকাই খেলাপি। এটি ব্যাংকের নিজস্ব তথ্য।

রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া নতুন নয়টি ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। অনুমোদন পাওয়ার আগেই সাইনবোর্ড লাগিয়ে দপ্তর খুলে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছিল ব্যাংকটি। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারীরা।

ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে বিস্তারিত তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই। সাধারণ আমানতকারী ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে আমানত নেওয়া এবং ধার করে বর্তমানে টিকে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটি পুরো ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি (সিস্টেমেটিক রিস্ক) তৈরি করেছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।

এরপরই মূলত ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেওয়া শুরু হয়। এর ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে গেলে গত বছরের ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক মাহাবুবুল হক চিশতীকেও পদ ছাড়তে হয়। এরপর ১৯ ডিসেম্বর দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে ব্যাংকের এমডি এ কে এম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপরই বেরিয়ে আসে যে সরকারি খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের আমানত আটকে গেছে ব্যাংকটিতে। এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা আছে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায়। সুদসহ যা ৫১০ কোটিতে পৌঁছেছে। এ ছাড়া জীবন বীমা করপোরেশনের আটকা পড়েছে শতকোটি টাকার বেশি।

ব্যাংক সূত্র জানায়, মূলধন সংকট কাটাতে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমতি পায় ফারমার্স ব্যাংক। বন্ডটির নাম দেওয়া হয়েছে দি ফারমার্স ব্যাংক প্রসপারেটি বন্ড-২০১৭। বন্ডটির বিপণনের দায়িত্ব পায় রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট। তবে এখন পর্যন্ত সেই বন্ড বিক্রি করতে পারেনি ব্যাংকটি।

গত জানুয়ারিতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা চৌধুরী নাফিজ সারাফাত। ফোনে যোগাযোগ করে গতকাল তাঁকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মহীউদ্দীন খান আলমগীরকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

সব মিলিয়ে বড় ধরনের সংকটে আছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দেওয়া এই ফারমার্স ব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটাও জরুরি। যেমন সাবেক ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের যথাযথ শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। তাহলে সবাই শিক্ষা নেবে। নইলে অনেকে উৎসাহ পাবেন।