এই লাভ, এই লোকসান

শ্যামবাজারের আড়তগুলোতে আনার পরে পেঁয়াজ বাছাই করা হয় এবং আকার অনুযায়ী কয়েক ভাগে ভাগ করে বিক্রি করা হয়। সেই কাজে ব্যস্ত একজন নারী শ্রমিক। গত রোববার শ্যামবাজারের নবীন ট্রেডার্সে।  ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
শ্যামবাজারের আড়তগুলোতে আনার পরে পেঁয়াজ বাছাই করা হয় এবং আকার অনুযায়ী কয়েক ভাগে ভাগ করে বিক্রি করা হয়। সেই কাজে ব্যস্ত একজন নারী শ্রমিক। গত রোববার শ্যামবাজারের নবীন ট্রেডার্সে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
>
  • শ্যামবাজারের প্রতিষ্ঠা প্রায় ১৫০ বছর আগে
  • দোকানসংখ্যা ৩৫০-৪০০ টি
  • লেনদেন মাসে ৩০০ কোটি টাকা
  • বিক্রি হয় পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, আলু, পান, সুপারি
  • মসলাজাতীয় পণ্যের দাম পড়তি।
  • রোজায় পরিস্থিতি ভালো যাবে, আশা ব্যবসায়ীদের।

রাজধানীবাসী ভোরবেলা যখন ঘুম থেকে উঠতে শুরু করে তার আগেই খুলে যায় শ্যামবাজারের আড়তগুলোর কপাট। আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, পরিবহন শ্রমিকের আনাগোনায় মুখরিত হয় বি কে দাস রোড, নর্থ ব্রুক হল রোড ও বাকল্যান্ড বাঁধ এলাকা। এক দফায় পুরোদস্তুর কেনাবেচা হয় সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। এরপর আবার বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ব্যস্ততা থাকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।

শ্যামবাজারে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, পান, আলুসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের এই পাইকারি ব্যবসা চলছে প্রায় দেড় শ বছর ধরে। এর মধ্যে অনেকে ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। অনেকে দোকান কর্মচারী থেকে আড়তমালিক হয়েছেন। অনেকে বড় ব্যবসায়ী থেকে নিঃস্ব হয়েছেন। এর মধ্যে ব্যবসা বড় হয়েছে, দোকানসংখ্যা বেড়েছে, পণ্য বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। আবার শ্যামবাজার থেকে ব্যবসা সরে গেছে। কিন্তু একটি পুরোনো রীতি ও প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে শ্যামবাজারে। তা হলো, বাকির ব্যবসা এবং লাভ-লোকসানের অনিশ্চয়তা।

শ্যামবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এ বাজারে সিংহভাগ কেনাবেচা হয় বাকিতে। প্রায়ই খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা আড়তদারকে বাকির টাকা ফেরত দেন না। আবার কোন চালানে লাভ হবে, আর কোন চালানে লোকসান, তা আন্দাজ করা খুব কঠিন। সব মিলিয়ে দেশের অন্যান্য পাইকারি বাজারের চেয়ে শ্যামবাজারে লাভ-লোকসানের অনিশ্চয়তা সবচেয়ে বেশি থাকে।

রাজধানীর তো বটেই, শ্যামবাজার দেশের কৃষিপণ্যের শীর্ষস্থানীয় বাজার। বুড়িগঙ্গার তীরে বাজারটি শ্যামবাজার নামে পরিচিত হলেও এলাকার নাম ফরাশগঞ্জ। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী বইয়ের তথ্যানুযায়ী, ১৭৪০ সালে ঢাকার নায়েব নাজিম নওয়াজিশ মোহাম্মদ খান ফরাসি বণিকদের বুড়িগঙ্গার তীরে একটি গঞ্জ বা বাজার বসাবার অনুমতি দেন। সেই থেকে এলাকাটি ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। আর নাম হয় ফরাশগঞ্জ। শ্যামবাজার নামটি কীভাবে এল, তা-ও বইতে উল্লেখ করেন মুনতাসীর মামুন। তিনি বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ করে জানান, ফরাশগঞ্জের অট্টালিকা রূপলাল হাউসের কাছেই একটি পুল ছিল, যা শ্যামবাবুর পুল নামে পরিচিত ছিল। এই শ্যামবাবু কে, তা জানা যায়নি। তাঁর নামেই শ্যামবাজার হয়েছে বলে অনুমান মুনতাসীর মামুনের।

অবশ্য স্থানীয় পুরোনো ব্যবসায়ীরা জানান, প্রায় দেড় শ বছর আগে শ্যামবাজারে কৃষিপণ্যের ব্যবসা শুরু হয়। এ বাজারে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৫০-৪০০ আড়ত আছে। এসব আড়তে মাসে কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

যাঁরা নৌপথে দক্ষিণবঙ্গে যাতায়াত করেন, তাঁরা হাতের বাঁ পাশে শ্যামবাজারকে রেখে সদরঘাট দিয়ে নৌযানে ওঠেন। এটি ছাড়াও শ্যামবাজারে যাওয়ার কয়েকটি রাস্তা রয়েছে। তবে প্রতিটিতে যানজট লেগে থাকে সারাক্ষণ। গত রোববার সকালে রিকশা, ভ্যান ও ছোট ট্রাকের জট ঠেলে গুলিস্তান থেকে শ্যামবাজার পৌঁছাতে মোটরসাইকেলে সময় লাগল প্রায় এক ঘণ্টা। ততক্ষণে দিনের মূল কেনাবেচা শেষ করে ফেলেছেন আড়তদারেরা। একটু ফুরসত পেয়ে আড়তমালিক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা কথা বলার সুযোগ পেলেন।

নবীন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, তিন দশক আগে শ্যামবাজারের একজন কর্মচারী হিসেবে এ এলাকায় কাজ নেন তিনি। বর্তমানে ৩টি আড়তের মালিক। তবে ৭-৮ বছর আগেও তার আড়ত ছিল ১০ টি। লোকসান দিয়ে একের পর আড়ত বন্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘গত রোজার ঈদের আগে ১৬ লাখ টাকা লোকসান হয়। ঈদুল আজহার আগে আবার ১২ লাখ টাকা লাভ হয়। গত ৩ মাসে আবার ৩৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’
নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘পচনশীল পণ্যের ব্যবসায় কখন লাভ হবে, কখন লোকসান হবে, সেটা কেউ বলতে পারে না। এই লাভ হলো, আবার এই লোকসান। এভাবেই বছরের পর বছর চলছে শ্যামবাজারের আড়তের ব্যবসা।’

আমদানি আর আগাম কেনায় ঝুঁকি বেশি
শ্যামবাজারে ব্যবসার কয়েকটি ধরন আছে। আড়তদারদের অনেকে আমদানি করে পণ্য বিক্রি করেন। অনেকে আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ব্যবসা করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফড়িয়ারা পণ্য নিয়ে এসে শ্যামবাজারের আড়তে দেন। সেটাও কমিশনে বিক্রি হয়। কমিশনের ব্যবসার পাশাপাশি আড়তদারেরা অনেক সময় পণ্য কিনে বিক্রি করেন। একে বলা হয় ‘ফরোয়ার্ড’ কেনা। এই ‘ফরোয়ার্ড’ কেনা আর আমদানিতেই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি মো. সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামালের ব্যবসায় অনিশ্চয়তা সবচেয়ে বেশি। তাই লোকসানের ঝুঁকিও বেশি। যাঁর ভাগ্য ভালো থাকে, তাঁর লাভ হয়। যাঁর ভাগ্য খারাপ, তাঁকে লোকসান দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজ, রসুনের মতো পণ্যগুলোর দাম খুব ওঠানামা করে। বাজারে সরবরাহে টান পড়লেই দাম চড়ে যায়। আবার সরবরাহ বেশি হলে দাম একেবারেই কমে যায়।

শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা তাই বাজারে সরবরাহের খোঁজ ভালোভাবে রাখেন। অবশ্য দেশের পেঁয়াজ-রসুনের মতো কৃষিপণ্যের বাজারে শ্যামবাজারের হিস্যা আগের চেয়ে কমে গেছে। এখন ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পাইকারি দোকান। আমদানিকারকেরাও এখন আর পুরোপুরি শ্যামবাজারকেন্দ্রিক নন। এর ফলে বাজারের প্রকৃত সরবরাহ কতটুকু, তা আন্দাজ করতে পারেন না ব্যবসায়ীরা। এর ফলে অনেকে আমদানি ছেড়ে নির্ঝঞ্ঝাট কমিশন ব্যবসা করছেন। অনেকের আমদানির লাইসেন্স আছে। তবে প্রকৃত আমদানিকারক শ্যামবাজারে হাতেগোনা।

কমিশন পণ্যভেদে ভিন্ন। পেঁয়াজে আমদানিকারকের কাছ থেকে আড়তদার প্রতি কেজিতে ৬০ পয়সা ও ক্রেতার কাছ থেকে ৩০ পয়সা পান। রসুনে তা ১ টাকা ও ৫০ পয়সা। কমিশনের হার ঠিক হয় সমিতির মাধ্যমে। কেউ নির্ধারিত হারের বেশি নিলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও দোকান কয়েক দিন বন্ধ রাখার শাস্তি রয়েছে।

বাকির ব্যবসা, জামানত সুনাম
শ্যামবাজারে আমদানিকারকেরা আড়তদারদের বাকিতে পণ্য সরবরাহ করেন। শুধু মুঠোফোনে বলে দিলেই হয়, ‘আমাকে ১০০ বস্তা মাল দেন।’ আড়তদারেরা এই পণ্য আবার বাকিতে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করেন। পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো জামানতের ব্যবস্থা থাকে না, চলে বিশ্বাস ও সুনামের ওপর। অবশ্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কেউ টাকা ফেরত না দিলে তাঁর সঙ্গে কেউ ব্যবসা করেন না। সমিতিও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

শ্যামবাজারের বাইরের ক্রেতারা পণ্য নিয়ে টাকা না দিলে আর বিশেষ কিছু করার থাকে না আড়তদারদের। এভাবে অনেক টাকা খোয়াও যায়, যার ভাগ নেন না আমদানিকারক। রূপলাল হাউসের নিচতলার ফরিদপুর বাণিজ্যালয়ের মালিক প্রদীপ সাহা বলেন, ‘বাকি টাকার একটি অংশ আর ফেরত পাওয়া যাবে না, এটা মেনে নিয়েই আমরা বছরের পর বছর ব্যবসা করছি। এর বাইরে কিছু করার নেই।’ তিনি বলেন, সব সময় ব্যবসায়ীরা যে টাকা মেরে দেওয়ার ধান্দায় থাকেন, তা কিন্তু নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোকসান দিয়ে তাঁরা পুঁজি হারিয়ে ফেলেন।

বি কে দাস রোডের কাছেই বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং। সেখানে দুপুরের খাবার বিকেলে খেয়ে আমরা যখন অফিসমুখী, তখন শ্যামবাজারে দিনের দ্বিতীয়বারের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।