পিছিয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম বন্দর

কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ির শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের পরপরই চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশের সড়কে গাড়ির জট লেগে যায়। গতকাল দুপুরে সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ির শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের পরপরই চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশের সড়কে গাড়ির জট লেগে যায়। গতকাল দুপুরে সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
>
  • ৩৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি
  • দুই দিনে রপ্তানি হয়নি ১ হাজার ৬৯৮ কনটেইনার পণ্য
  • জেটিতে ভেড়ানোর অপেক্ষায় বহির্নোঙরে কনটেইনার জাহাজের সারি লম্বা হচ্ছে।

পণ্য পরিবহনের চাপে বন্দরে জাহাজ আসার পরও আমদানি পণ্য হাতে পেতে এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গড়ে পাঁচ দিন বেশি সময় লাগছে। তিন মাস ধরে জেটিতে ভেড়ানোর জন্য বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে গড়ে ২০টি কনটেইনার জাহাজকে। দিন যত গড়াচ্ছে, ততই বন্দরে সেবা পেতে দেরি হচ্ছে। আর এমন সময়েই দফায় দফায় পরিবহনশ্রমিকদের কর্মসূচি বন্দরকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে।

দুই দফায় গত ৩৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি কর্মসূচির কারণে বড় ক্ষতি হয়েছে রপ্তানি পণ্য পরিবহনে। গত রোববার ও গতকাল সোমবার দুদিনে ১ হাজার ৬৯৮ একক কনটেইনার রপ্তানি পণ্য না পেয়ে বন্দর ছেড়ে গেছে পাঁচটি জাহাজ, যেগুলোর বড় অংশই তৈরি পোশাকশিল্পের। রপ্তানিকারকের প্রতিনিধিরা এসব পণ্য এই পাঁচটি জাহাজে পরিবহন করার জন্য বুকিং দিলেও তা বন্দরে নেওয়া যায়নি। এসব পণ্য চট্টগ্রামের ১১টি ডিপোতেই আটকা ছিল। বেসরকারি ডিপো ও জাহাজ কোম্পানিগুলোর হিসাবে এই তথ্য উঠে এসেছে।

শীর্ষ বন্দর ব্যবহারকারী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই বন্দরে জাহাজজট লেগে আছে। এর মধ্যে কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি রপ্তানি খাতে শঙ্কা তৈরি করছে। কারণ, সময়মতো রপ্তানি করতে না পারায় এসব পণ্য নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ক্রেতার হাতে পৌঁছাবে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে রপ্তানি মূল্যে ছাড় দিতে হয়।

রপ্তানি পণ্যের মতো আকস্মিক কর্মবিরতি কর্মসূচির কারণে এখন বন্দরে জাহাজজটও বেড়েছে। গত দুই দিনের ব্যবধানে বহির্নোঙরে অপেক্ষায় থাকা কনটেইনার জাহাজের সংখ্যা পাঁচটি বেড়ে ২২ টিতে উন্নীত হয়েছে। এর অর্থ হলো এসব জাহাজের পণ্য হাতে পেতে ব্যবসায়ীদের আরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। পর্যাপ্ত জেটি না থাকায় দুই বছর ধরে লেগে থাকা জট থেকে বন্দরও বেরিয়ে আসতে পারছে না।

ব্যবহারকারীরা বলছেন, পণ্য পরিবহন বাড়লেও গত সাড়ে ১০ বছরে বন্দরে একটি জেটিও নির্মাণ করা হয়নি। এ সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা মনোযোগী হন পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে। সেখানে বন্দর নির্মাণ না হওয়ায় সব চাপ পড়েছে এ বন্দরের ওপর। এখন চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোয় নিত্যনতুন রেকর্ড করলেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বন্দর পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পণ্য পরিবহনকারী গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় বন্দরে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এটি এখন পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা।’ তিনি জানান, সারা দেশের পণ্য পরিবহন হয় এই বন্দর দিয়েই। এই বন্দরে পণ্য পরিবহন বন্ধ হলে সারা দেশেই প্রভাব পড়ে। দেশের স্বার্থে এমন কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

পণ্য পরিবহনের হিসাব অনুযায়ী, কনটেইনারে আমদানি-রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৯৮ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে পরিবহন হয়। সাধারণ পণ্যসহ মোট আমদানি-রপ্তানির ৯৩ শতাংশ সমুদ্রপথে এই বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া হয়। এ কারণে এই বন্দরে এক ঘণ্টার কর্মসূচিও বড় প্রভাব ফেলে দেশের অর্থনীতিতে। গত অর্থবছরের হিসাবে, প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন হয় ২ লাখ ৩৩ হাজার টন বা সোয়া ২৩ কোটি কেজি।

দুই দফায় ৩৮ ঘণ্টার কর্মসূচি
গত শনিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে পরিবহনশ্রমিকদের আকস্মিক ধর্মঘটে ধাপে ধাপে বন্দরের কার্যক্রম অচল হতে থাকে। রোববার রাতে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল শিথিল হওয়ার আগেই আবারও আকস্মিক কর্মবিরতি শুরু করেন কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ির শ্রমিকেরা। তাঁদের অভিযোগ, রোববার রাতে বন্দর এলাকায় স্থানীয় মানুষজন কিছুসংখ্যক শ্রমিককে মারধর করেন। এর প্রতিবাদে রাত ১০টা থেকে তাঁরা কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন। আকস্মিক এই কর্মসূচির কারণে রাত ১০টার পর থেকে বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো, খালাসের মতো সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বন্দর ও পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে গতকাল বেলা দুইটা থেকে আবার গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়।

প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবুবকর সিদ্দিকী জানান, বখাটে লোকজনের হামলার প্রতিবাদে তাঁরা কাজ বন্ধ করেছেন। বন্দর ও পুলিশ প্রশাসন থেকে বিষয়টি সুরাহার আশ্বাস দেওয়ায় তাঁরা কাজ শুরু করেছেন।

সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, কর্মবিরতি কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর যানবাহনের চাপে পণ্যবাহী গাড়ির জট তৈরি হয়। দীর্ঘ ১২ কিলোমিটার বন্দর টোল রোড ছাড়িয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভাটিয়ারী স্টেশন এলাকা পর্যন্ত এই যানজটের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মহাসড়ক ও বন্দর টোল রোডসহ ২০ কিলোমিটার যানজট তৈরি হয়। সীতাকুণ্ডের ট্রাফিক পরিদর্শক রফিক আহম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরমুখী ও বন্দর ছেড়ে আসা গাড়ির চাপের কারণে এই জট সৃষ্টি হয়েছে।