মালিকদের মজুরি প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য

>
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ
তৈরি পোশাকশিল্পের মজুরি নির্ধারণে কাজ করছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। সেখানে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি মজুরির প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে উভয় পক্ষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে গত বুধবার কথা বলেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

প্রথম আলো: পোশাকশিল্পের জন্য গঠিত মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি নিম্নতম মজুরি ১২ হাজার ২০ টাকা দাবি করেছেন। বিপরীতে মালিকপক্ষের প্রস্তাব মাত্র ৬ হাজার ৩৬০ টাকা। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন উভয় পক্ষের প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করে ১৬ হাজার টাকা মজুরি দাবি করেছে। এই অবস্থায় গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে কী করা দরকার?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ: শ্রম আইনের নির্দেশনায় আছে, মজুরি বোর্ড নিজেরা তদন্ত করে মজুরির সুপারিশ করবে। কিন্তু বোর্ড সেটি না করে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এটি ঠিক নয়। এখন গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে হলে বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্য একটি মজুরি প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারেন। আরও ভালো হয় বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বোর্ড একটি প্রস্তাব তৈরি করলে। সেটির ওপর মালিক ও শ্রমিকপক্ষ মতামত দেবে। আরেকটি সমাধান হচ্ছে, মালিকেরা নতুন করে প্রস্তাব দিক। শ্রমিকদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলেও তা আলোচনার জন্য অ্যাজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করা যায়। তবে মালিকদের প্রস্তাব অ্যাজেন্ডা হিসেবে অগ্রহণযোগ্য। তাঁরা অনেক কম মজুরি প্রস্তাব করেছেন। এটি মেনে নেওয়া যায় না।

প্রথম আলো: পোশাকশ্রমিকদের জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছে সিপিডি। গত সপ্তাহে গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পাশাপাশি তারা নিম্নতম মজুরি ১০ হাজার ২৮ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবেই বিভিন্ন শ্রমিকনেতা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এটি বাস্তবসম্মত নয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ: সিপিডির গবেষণাটি খুবই ভালো হয়েছে। মজুরি বোর্ড চাইলে সিপিডির তথ্য-উপাত্ত আমলে নিতে পারে। তবে সমস্যা হচ্ছে সিপিডির সুপারিশ নিয়ে। তারা তথ্য দিয়েছে, একেকটি শ্রমিক পরিবারে উপার্জনক্ষম সদস্যসংখ্যা ২ দশমিক ১। এটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা নয়। বাংলাদেশের অনেক সরকারি ও বেসরকারি অফিসে স্বামী-স্ত্রী দুজন একসঙ্গে কাজ করেন। তাঁদের কি বেতন ভাগ করে দেওয়া হয়? সিপিডির গবেষণার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তাদের সুপারিশকে প্রত্যাহার করার অনুরোধ করব। এটি কোনোভাবেই বিবেচনার কোনো বিষয় হতে পারে না।

প্রথম আলো: প্রতিবারই নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের সময় মালিকেরা পোশাক কারখানার সক্ষমতা, কম উৎপাদনশীলতা, ব্যবসা খারাপ কিংবা ব্যবসার ব্যয় বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন অজুহাত সামনে নিয়ে আসেন। শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়ার এই কৌশল কীভাবে বন্ধ করা যায়?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ: পোশাক কারখানার মোট খরচের ২০ শতাংশের কম হচ্ছে শ্রমিকের মজুরি। তাই ২০ শতাংশ বাড়ানো হলেও মোট খরচের অর্ধেকের কমই থাকবে। নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার সামর্থ্য বিবেচনায় রাখার কথা বলা হয়েছে। আমরা দেখছি, রানা প্লাজা ধসের পর প্রতিবছরই শিল্পের সামর্থ্য বাড়ছে। বড় বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশে ব৵বসা করছে। তাই ব্যবসা নয়, বরং ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য নিয়ে সমস্যা আছে। সরকার যে প্রণোদনা দেয় কিংবা কর মওকুফ-সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করে, তার বিপরীতে মজুরি ও শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেন না মালিকেরা।  শিল্পের কোনো অংশের সামর্থ্যের অভাব থাকলে সেটি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। বিদেশি কর্মকর্তাকে ৫০ গুণ বেশি বেতন দিতে সামর্থ্যের ঘাটতি হয় না। শুধু শ্রমিকের মজুরির বেলায় সামর্থ্যের প্রশ্ন, এটি হতে পারে না। আরেকটি দিক হচ্ছে, আমাদের ছোট উদ্যোক্তাদের সামর্থ্য বৃদ্ধির কর্মসূচি দেশে নেই। ছোট মালিকদের সামর্থ্য কম—এই অজুহাত দিয়ে বড় কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের ঠকান। এই দায়ভার শ্রমিকদের ওপর চাপানো যাবে না।

প্রথম আলো: শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি নির্ধারণ না হলে ভবিষ্যতে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে?

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ: শ্রমিক সংগঠন দুর্বল বলেই কিন্তু মজুরি বোর্ডের প্রশ্ন আসে। সেটি না হলে তারা নিজেরাই দর-কষাকষি করে মজুরি নির্ধারণ করতে পারত। এখানে শ্রমিকদের চাপের চেয়ে বোর্ড ও সরকারের বড় ভূমিকা রাখা দরকার। রাজনৈতিক চাপ বা সুনাম কুড়ানো নয়, একটি গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজটি করতে হবে। কত মজুরি হলে একটি পরিবার চলতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, মজুরি কম রেখে যেনতেনভাবে শিল্পের মুনাফা বাড়ানোর যে দর্শন নিয়ে আমরা চলছি, তা দিয়ে শিল্পের সামর্থ্যকে ক্ষতি করছি। শিল্পকে ব্যাহত করছি। শিল্পকে টেকসই করতে হলে শ্রমিকের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।