মানব উন্নয়নের বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের দৃপ্ত অর্জন

সেলিম জাহান
সেলিম জাহান

২০১৮ সালের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন পরিসংখ্যান বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপিত হলো গত শুক্রবার। ১৮৯টি দেশের মানব উন্নয়নের বিভিন্ন মাত্রিকতার মান, তাদের অগ্রগতি, মানব উন্নয়নের অসমতা ও বৈষম্য, মানব বঞ্চনার স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে দেয় তথ্যে। দেশে দেশে এসব নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হবে, বিভিন্ন পর্যালোচনায় উঠে আসবে বিভিন্ন মতামত, নীতিনির্ধারকদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলবে এই প্রতিবেদন।

এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যেতে পারে কেমন করছে আমাদের বাংলাদেশ? কোন কোন জায়গায় আমাদের অর্জন গর্ব করার মতো। আবার কোন কোন জায়গায় আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে?

সেই বহুল আলোচিত মানব উন্নয়ন সূচক দিয়েই শুরু করা যাক না? স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান—এই তিনটি নির্দেশিকা নিয়ে তৈরি এই সামষ্টিক সূচক দিয়ে কোনো দেশের মানব উন্নয়নের মৌলিক দিকগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা দেয় এ সূচক। এই সূচকের মানের ভিত্তিতে মানব উন্নয়নে সব দেশের মধ্যে কোন ধাপে কোন দেশ আছে তা-ও নির্ধারণ করা হয়। বিশ্বের ১৮৯ দেশের মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের স্থান ১৩৬।

উঁহু, এই ছোট্ট তথ্য পুরো গল্প বলে না—দেখতে হবে আরও খতিয়ে। গত এক বছরে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে দুই ধাপ—১৩৮ থেকে ১৩৬। এ বছর মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত না হলে (ধাপ ১০৬) বাংলাদেশের এগোত ৩ ধাপ। একটু দীর্ঘতর সময়সীমা নেওয়া যাক। গত পাঁচ বছরে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে ৭ ধাপ।

এবার ধাপ ছেড়ে মানের দিকে তাকানো যাক। ১৯৯০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এই ২৭ বছরে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান বেড়েছে ৫৭ শতাংশ—০.৩৮৭ থেকে ০.৬০৬। এই সময়সীমায় বিশ্বের মানব উন্নয়ন সূচক বেড়েছে ২১ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৩২ শতাংশ। অতএব বাংলাদেশ এগিয়ে আছে অনেক।

মানব উন্নয়নের অন্যান্য সমন্বিত সূচকের দিকে চোখ ফেরাই। মানব উন্নয়ন সূচকের তিনটি মাত্রিকতায় অসমতাকে যদি বিচার করি, তাহলে বাংলাদেশের মানব উন্নয়নের মান ২৪ শতাংশ হ্রাস পায়—ভারতের ২৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশে নারীর মানব উন্নয়ন সূচক পুরুষের ৮৮ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় তা ৮৩ শতাংশ।

সূচক বাদ দিয়ে একেবারে যদি উপাত্তের কাদামাটিতে নেমে আসি। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭৩ বছর—ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায় ৬৯ বছর। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ২৪ এবং অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুমৃত্যুর হার ৩৪—উন্নয়নশীল বিশ্বে এ সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ৩৩ ও ৪৩। বাংলাদেশে তরুণীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৯৪ শতাংশ, তরুণদের ৯১ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ, ভারতে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে ৯৭ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়, উন্নয়নশীল দেশে সেই সংখ্যা ৮৬ শতাংশ।

মানব উন্নয়নের নানা অঙ্গনে নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেকখানি। প্রাথমিক শিক্ষায় তো বটেই, এমনকি মাধ্যমিক শিক্ষায়ও। বাংলাদেশে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির হার বেশি, উন্নয়নশীল বিশ্বে যেটা কম। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১০০ হাজার জন্মে যেখানে ১৭৬, উন্নয়নশীল দেশে তা ২৩২। বাংলাদেশে যেখানে ৬২ শতাংশ নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের পন্থাগুলো অবলম্বন করেন, উন্নয়নশীল দেশে তা মাত্র ৫৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ এত সব অর্জন করেছে অনেক কম মাথাপিছু আয় নিয়ে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় মাথাপিছু আয় যেখানে ১০ হাজার ডলার (ক্রয়ক্ষমতা সমতাসম্পন্ন ডলারের পরিমাপে), ভারতে যেখানে ৬ হাজার ডলার, বাংলাদেশে তা মাত্র সাড়ে ৩ হাজার ডলার। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ অন্যদের তুলনায় অনেক দক্ষতার সঙ্গে তার আয়কে সামাজিক উন্নয়নে রূপান্তরিত করতে পেরেছে। এসবই অত্যন্ত প্রশংসনীয়, নিঃসন্দেহে।

কিন্তু মানব উন্নয়নের কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও মনোযোগের প্রয়োজন আছে। জন্মনিবন্ধন মানুষের মৌলিক অধিকারই শুধু নয়, এটি একটি আর্থসামাজিক প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই নিবন্ধনের হার মাত্র ২০ শতাংশ, উন্নয়নশীল দেশে যেটা ৬৮ শতাংশ—ভারতে ৮০ শতাংশ।

বাংলাদেশে সামাজিক বিনিয়োগ আরও বেশি বাড়ানো দরকার। ভৌত অবকাঠামোই শুধু মূলধন নয়, মানব মূলধনও একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ মূলধন। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যয় জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশের কম, উন্নয়নশীল বিশ্বে যা ৫ শতাংশের বেশি। এখন আমরা সবাই জানি যে এই ব্যয় বাড়াতে গেলে অর্থায়নের প্রয়োজন। কেমন করে সেই অর্থায়ন হবে, যদি আমাদের কর-আয় জাতীয় আয়ের ৯ শতাংশের কম হয়—যেখানে উন্নয়নশীল দেশে তা ১১ শতাংশের বেশি।

আমাদের প্রবৃদ্ধির একটি বড় চালিকা শক্তি বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ, যা দেশের জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশের বেশি। সমস্যা হচ্ছে যে এ-জাতীয় নির্ভরতা পুরো কাঠামোতে একটা নাজুকতারও সৃষ্টি করে। যদি কোনো কারণে মধ্যপ্রাচ্য অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়, তাহলে তার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের মানব উন্নয়নে পড়তে বাধ্য।

নারী-পুরুষ সমতা কিংবা নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরও কিছু করণীয় আছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশে কৃষিবহির্ভূত খাতে নারীর কর্ম নিয়োজন মাত্র ১৮ শতাংশ, উন্নয়নশীল দেশের ৩৬ শতাংশের অর্ধেক। বাংলাদেশে মাত্র ৩৬ শতাংশ নারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মুঠোফোনভিত্তিক আর্থিক সেবা পান; অথচ উন্নয়নশীল দেশে ৫৮ শতাংশ নারী এই সেবা ভোগ করেন। বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়স্ক নারীদের ৫৯ শতাংশেরই বিয়ে হয়ে যায় তাঁদের বয়স ১৮ পেরোনোর আগেই। উন্নয়নশীল দেশে এ সংখ্যা ২৭ শতাংশ মাত্র।

বজায়ক্ষম মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে মানব উন্নয়নের পরিমাণগত দিক শুধু নয়, তার গুণগত মানও বাড়ানো প্রয়োজন। উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য ১৬ জন চিকিৎসক ও ২০টি হাসপাতাল শয্যা লভ্য। বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে ৫ ও ৬। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশে ১ জন শিক্ষক গড়ে ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান, উন্নয়নশীল বিশ্বে ২৫ জন।

চূড়ান্ত বিচারে, নিশ্চয়ই মানব উন্নয়নের কোনো কোনো দিকে অর্জনের অগ্রগতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুযোগ আছে। কিন্তু তার জন্য আমাদের অর্জনের আলো দেখতে আমরা যেন ভুল না করি। এই অর্জন আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এই অর্জনের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ দৃপ্ত পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে আগামী দিনগুলোতে।

ইউএনডিপির মানবউন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক