জাপানি বিনিয়োগে সুসময়

>

• দেশে এক দশকে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে প্রায় চার গুণ হয়েছে
• আসছে বড় বড় নতুন কোম্পানি
• অবশ্য অন্যরা আরও বেশি পাচ্ছে
• আগামী বছরগুলোতে দেশে জাপানি বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে আশা
• জাপান বিনিয়োগকারীদের জন্য এখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে
• আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি চেয়েছে

বাংলাদেশে বিনিয়োগে জাপানি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। এক দশক আগে এ দেশে কর্মরত জাপানি কোম্পানির যে সংখ্যা ছিল, এখন তা বেড়ে প্রায় চার গুণ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে কাজ শুরু করেছে ২৪টি কোম্পানি। এখনো জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো বড় বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসছে।

দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনার কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলো আশা করছে, আগামী বছরগুলোতে দেশে জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ, জাপান তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য এ দেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি চেয়েছে তারা। বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও মুনাফা পরিস্থিতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব ফুটে উঠছে দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্থা জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) জরিপ প্রতিবেদনেও।

এফডিআই পরিস্থিতি নিয়ে জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা প্রতিবেদন ধরে জেট্রো বিভিন্ন দেশে কর্মরত সেই দেশের কোম্পানির সংখ্যা উল্লেখ করে। তাদের হিসাবে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৭০টি, যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪৫টিতে। এই সংখ্যা ২০১৭ সালে আরও বেড়ে ২৬৯টিতে উন্নীত হয়।

জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিনিয়োগ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ১ হাজার ১৩০ কোটি জাপানি ইয়েন বিনিয়োগ করেছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮৪০ কোটি টাকার সমান। এই অর্থের ৮৭ শতাংশই মূলধন। অবশ্য অর্থের হিসাবে বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৬ সালে আরও বেশি ছিল। ওই বছর বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করেছিল ১ হাজার ৫৯০ কোটি ইয়েন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কার্যালয়ে গত রোববার এক অনুষ্ঠানে এ দেশে জেট্রোর ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি কোগা তাইকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখছি অনেক জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। আগে তারা এ দেশে পণ্য তৈরি করে শুধু রপ্তানির কথা বিবেচনা করত। এখন অভ্যন্তরীণ বাজারেও তাদের আগ্রহ তৈরি হয়েছে।’ 

বড় কোম্পানির বিনিয়োগ

সম্প্রতি বাংলাদেশে বড় বেশ কিছু জাপানি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। আবার কেউ কেউ নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী হোন্ডা মোটর করপোরেশন। তারা মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোনে ২৫ একর জমিতে মোটরসাইকেল সংযোজন ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানা করেছে, যেটির চলতি বছরেই উৎপাদনে যাওয়ার কথা। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩৬৯ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে)।

তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান জাপান টোব্যাকো গত জুনে বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কিনে নেয়। এতে জাপানি কোম্পানিটি বিনিয়োগ করছে ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিপ্পন স্টিল অ্যান্ড সুমিতমো মেটাল দেশীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্টসের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইস্পাত কারখানা করছে। গত রোববার ১০০ একর জমি বরাদ্দের বিষয়ে বেজার সঙ্গে চুক্তি করেছে তারা।

দেশের বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট করপোরেশন ২৪ হাজার কোটি টাকার একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেখানে বিনিয়োগ করছে মিতসুবিশি করপোরেশন। সম্প্রতি এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

জাপানের বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি সজিত করপোরেশনও মিরসরাইয়ে এক হাজার একর জমি বরাদ্দের জন্য আবেদন জানিয়েছে। তারা সেখানে একটি শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

জাপানের আরেক মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইয়ামাহাও এ দেশে মোটরসাইকেল কারখানা করতে চায়। এ জন্য তারা মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি চেয়েছে বলে বেজা সূত্রে জানা গেছে। এর বাইরে জাপানের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। 

তবু বাংলাদেশে কম

বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়লেও তা প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জাপানি বিনিয়োগ পাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের মতো আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে জাপানি বিনিয়োগ অনেক বেশি হারে যাচ্ছে। এমনকি পাশের দেশ মিয়ানমারও বাংলাদেশের কয়েক গুণ বেশি জাপানি বিনিয়োগ পাচ্ছে।

২০১৭ সালে ভিয়েতনাম ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি, ভারত ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি, পাকিস্তান ৭ হাজার ২৪০ কোটি ও মিয়ানমার ১১ হাজার কোটি ইয়েনের জাপানি বিনিয়োগ পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পেয়েছে ১ হাজার ১৩০ কোটি ইয়েনের বিনিয়োগ। 

আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল

জাপান তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সরকারের কাছে তারা এ আগ্রহের কথা জানিয়েছে। নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলটির জন্য তারা প্রায় এক হাজার একর জমি চেয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায়।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চলছে। এর প্রথম ধাপ হবে প্রায় ৫০০ একর জায়গায়। পরবর্তী সময়ে আরও ৫০০ একর যোগ হবে। জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগামী ২০২০–২১ সালে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল কার্যক্রম শুরু করবে। তখন এ দেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে। এখন প্রতিনিয়ত জাপানি কোম্পানি বিনিয়োগের খোঁজখবর নিচ্ছে।