মুদ্রা পাচারে দূষিত লন্ডনের আর্থিক ব্যবস্থা

যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাচারের নিজস্ব গোপন নেটওয়ার্ক রয়েছে। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাচারের নিজস্ব গোপন নেটওয়ার্ক রয়েছে। ছবি: রয়টার্স

অবৈধ অর্থ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বরাবরই শীর্ষে যুক্তরাজ্য। সম্প্রতি এসব ক্ষেত্রে আরও কঠোর হয়েছে দেশটির সরকার। লন্ডন থেকে মুদ্রা পাচারে আগ্রহী স্বার্থান্বেষী মহলের দিকে নজর দেওয়ায় এর মধ্যে রাশিয়ায় সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে সরকারের। কিন্তু এত হাঁকডাক দিলেও আসলে যুক্তরাজ্যে অপরাধী সব সময় নিভৃতেই থেকেছে।

যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা–বিষয়ক মন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, ‘কেউ যদি অবৈধ অর্থ লুকানোর চেষ্টা করেন, আমরা সন্দেহাতীতভাবেই তাঁর কাছে পৌঁছাব।’

এত চেঁচামেচির পরও যুক্তরাজ্যে অপরাধী সব সময় নিভৃতেই থেকেছে। সম্প্রতি ‘দ্য ইকোনমিস্ট’–এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মুদ্রা পাচারের বিষয়ে লন্ডনের অবস্থান ও নেওয়া পদক্ষেপের বিভিন্ন দিক।

অর্থ পাচার যুক্তরাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থাকে বরাবরই দূষিত করেছে। জাতীয় অপরাধ সংস্থার (এনসিএ) ধারণা, প্রতিবছর হাজার হাজার বিলিয়ন পাউন্ডের আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্রিটিশ ব্যাংকগুলো থেকে পাচার হয়ে যায়। বিশ্বে সম্প্রতি সংঘটিত প্রায় সবগুলো আন্তসীমান্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি ২৩৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের ঘটনায় পদত্যাগ করেছেন ডেনমার্কের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ডানসকে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) থমাস বরগেন। ব্যাংকটির এস্তোনিয়া শাখায় সন্দেহজনক এ লেনদেন নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করার পর এক বিবৃতিতে বরগেন বলেন, এটি স্পষ্ট যে এস্তোনিয়া শাখায় সংঘটিত সম্ভাব্য এ অর্থ পাচারের ঘটনায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে ডানসকে ব্যাংক। এই ডানসকে ব্যাংকের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সংযোগ আছে।

কনজারভেটিভ পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, ব্রেক্সিটের কারণে এমনিতেই যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বেশি থাকলে তা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আসলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ২০০৮ সালের মন্দার সময় যেসব দেশ ব্যয় সংকোচন পদক্ষেপ ও অর্থ সহায়তা নিতে বাধ্য হয়েছিল, তারা যদি এখন অবৈধ মুদ্রা পাচার রোধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারে, তাহলে আবারও ওই দেশগুলোর পুঁজিবাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

অবশ্য বিশ্বের অনেক দেশেই অবৈধ অর্থ সাদা করার বিষয়টি প্রচলন আছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যকে ব্যতিক্রম বলা যাবে না। নিউইয়র্ক, দুবাই, সিঙ্গাপুরের মতো শহরগুলোতেও অবৈধ অর্থ সাদা করা হয়। তবে লন্ডনের অবৈধ অর্থ আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে। কারণ বিপুল পরিমাণ মূলধন–প্রবাহ হয় এই শহরে। এনসিএ বলছে, বহু অবৈধ অর্থ ব্রিটিশ বেসরকারি স্কুলগুলোতে ঢালা হচ্ছে এবং সরকারকে এই সন্দেহজনক অর্থ প্রদানের তথ্য দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ওই সব অভিজাত স্কুল। সম্পত্তি মালিকানা আইন শিথিল হওয়ায় বিদেশিরাও সম্পদের মালিক হচ্ছেন। আইনজীবী ও জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে একেবারে সিদ্ধহস্ত। এসবের মধ্যে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাচারের নিজস্ব গোপন নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী প্রচারকেরা যাকে ‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য’ বলেন। আসলে এককথায় বলা যায়, মুদ্রা পাচারের দিক দিয়ে লন্ডন একটি আদর্শ জায়গা।

মুদ্রা পাচারের দিক দিয়ে লন্ডন পছন্দের জায়গা। ছবি: রয়টার্স
মুদ্রা পাচারের দিক দিয়ে লন্ডন পছন্দের জায়গা। ছবি: রয়টার্স

বলা হয়, সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কে মারতে চায়? এখন যদি অবৈধ অর্থ দমনে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে কী সমস্যা হতে পারে?
প্রথমেই অবৈধ অর্থের ওপর ভিত্তি করে যেসব সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে, সেগুলো হুমকির মুখে পড়বে। দেশজুড়ে যদি দমনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে তা বৈধ বিনিয়োগকেও ভড়কে দিতে পারে। গোপনীয়তা ও বৈধ কর কাঠামো থাকায় রাশিয়ার অনেক নাগরিক লন্ডনে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তাঁদের অনেকে মনে করেন, অবৈধ অর্থ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিলে তা সম্পত্তির বাজার ও পাউন্ডকে আঘাত করবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাঁরা। এমনিতেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের সরে আসার পর (ব্রেক্সিট) দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে ।

তবে মুদ্রা পাচার বা কালোটাকা প্রতিরোধের আবেদন জোরালো হচ্ছে। মুদ্রা পাচার দমন করার পদক্ষেপ নিলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ব্যাপক—এমন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি হিসাবে আর্থিক জালিয়াতি কারণে বছরে ৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতি হয় যুক্তরাজ্যের। অর্থাৎ ব্যক্তিপ্রতি ক্ষতির পরিমাণ ১০০ পাউন্ডের মতো। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে বিদেশিদের সম্পদের মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ আছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকদের হাতে। তাই এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে তা খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। বরং রাশিয়ান নাগরিকদের অবৈধ অর্থ ধরার লক্ষ্য নিলে তা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লিদিমির পুতিনের গোয়েন্দা সংস্থাকেই বিব্রত করবে।

এমন পরিস্থিতিতে পুরোনো আইন প্রয়োগের চেয়ে নতুন আইন প্রণয়ন সহজ হবে ব্রিটেনের জন্য। সম্প্রতি নেওয়া দুর্নীতিবিরোধী নতুন আইনের কারণে বেরিয়ে এসেছে অনেক কাহিনি। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন আইনের কারণে অপ্রকাশিত সম্পদ গোপন করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে দেশটিতে থাকা বিদেশি নাগরিকদের জন্য । চলতি মাসে ফেঁসে গেছেন আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার স্ত্রী। জামিরা হাজিয়েভা নামের ওই নারীকে এখন ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে—কীভাবে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন তিনি। ওই নারী লন্ডনের বিখ্যাত বিলাসবহুল দোকান হ্যারডস থেকে গত এক দশকে ২ কোটি ১০ লাখ ডলারের কেনাকাটা করেছেন। এমনকি তিনি ওই দোকান ও বার্কশায়ারের একটি গলফ ক্লাবও কিনে নিয়েছিলেন। জামিরা হাজিয়েভাকেও বলা হয়েছে তাঁর এত অর্থ কীভাবে হলো, সেটি ব্যাখ্যা করতে হবে । আর সেটি করতে না পারলে সম্পদ হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন তিনি।

জামিরা হাজিয়েভার স্বামী জাহাঙ্গীর হাজিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক অব আজারবাইজানের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৬ সালে জালিয়াতির দায়ে তাঁর ১৫ বছরের জেল হয়েছিল। একই সঙ্গে তাঁকে প্রায় ৪ কোটি ডলার ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

সমস্যা হলো, মুদ্রা পাচার রোধে আন্তসীমান্ত আইনি লড়াই করার পর্যাপ্ত লোকবল নেই ব্রিটেনের। এনসিএর বাজেট ইতিমধ্যে যতটুকু বাড়ানো যায়, তা বাড়ানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালির যেখানে এসব আইনি লড়াইয়ে লড়তে শখানেক দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা রয়েছে, সেখানে লন্ডনের রয়েছে মাত্র এক দুই ডজন। আসলে বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই ধরনের আইনি লড়াই সব সময়ই ব্যয় সাপেক্ষ। এ ছাড়া বহুদিন ধরে এসব মামলা চলতে থাকে। গড়ে সাত বছর লাগে এক একটা মামলার মীমাংসা হতে। এমন অবস্থায় প্রসিকিউটিং এজেন্সির ব্যয়বহুল খরচ বহন করার সক্ষমতা থাকতে হয়। এ ছাড়া মামলায় হেরে যাওয়ার ঝুঁকি তো থাকেই। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার ব্রিটেন ততটা পদক্ষেপের ক্ষেত্রে নয়।