এখন আফগানিস্তানের কাছ থেকেও শিখতে হবে, এটা দুঃখজনক

আবুল কাসেম খান
আবুল কাসেম খান

বিশ্বব্যাংক গত বুধবার ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা সূচক-২০১৯ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশ এক ধাপ উন্নতি করে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম অবস্থান পেয়েছে। এটাকে আমি দুভাবে দেখি। প্রথমত, ডুয়িং বিজনেসে উন্নতির জন্য সরকার দুই বছর ধরে কাজ করছে। প্রক্রিয়া চলমান। এ বছর ওয়ান স্টপ সার্ভিস বা এক দরজায় সব সেবা দেওয়া শুরু হবে। এতে আগামীবার ডুয়িং বিজনেস সূচকে উন্নতির আশা আছে। আমিও আশা রাখছি।

দ্বিতীয়ত, আমি ব্যাপক হতাশও। বিশ্বব্যাংকের সূচকে ১৭৬তম অবস্থান মানে, আমরা দুই বছরে কোনো উন্নতিই করিনি। আফগানিস্তানের মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ১৬ ধাপ এগিয়ে আমাদের পেছনে ফেলে সামনে চলে গেছে। এখন আমাদের আফগানিস্তানের কাছ থেকে শিখতে হবে, এটা দুঃখজনক। এটা আরও হতাশা তৈরি করছে। আমরা একটি স্থিতিশীল দেশ, আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি। আমরা বিনিয়োগের কথা বলছি, উন্নয়নের কথা বলছি, প্রবৃদ্ধির কথা বলছি, সেখানে আমাদের ডুয়িং বিজনেসে এই অবস্থা!

শুধু ডুয়িং বিজনেসের কথা বলব না, আজকে ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য যান, পাসপোর্ট করার জন্য যান, সরকারের অন্য কোনো সেবার জন্য যান—সহজে কোনো কিছু হচ্ছে না। হয়তো দালাল চক্র দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে, তাতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কোথাও জবাবদিহি নেই। আজ বেসরকারি ব্যাংক যদি সেবা দিতে ভোগান্তি দেয়, আমরা অন্য ব্যাংকে যেতে পারি। সরকারি সেবার ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার। যেসব কর্মকর্তা ভালো কাজ করেন, তাঁদের পুরস্কৃত করতে হবে। আবার যিনি সমস্যা তৈরি করেন, তাঁকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

এখন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) এসেছে, গাড়ির আধুনিক নম্বর প্লেট এসেছে—সরকারের উদ্যোগগুলো ভালো। কিন্তু সেবা পেতে সেই ভোগান্তি রয়ে গেছে। আগে কাজ কাগজে-কলমে হতো, এখন কম্পিউটারে হচ্ছে, লোকগুলো তো সেই আগেরই। বাংলাদেশে কোন সেবা আপনি সহজে পাবেন? আমি বলছি না সবাই খারাপ, কিন্তু কয়েকজনের জন্য পুরো প্রক্রিয়া নষ্ট হয়।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের রূপকল্প ও কার্যক্রম বেসরকারি খাতের সঙ্গে মিল রেখে হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গেলে আটকে যাচ্ছে। আমি বলব, দুই বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁদের মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। একটি বিষয় আটকে থাকলে, একজন ব্যবসায়ীর কতটা ক্ষতি হয়, সেটা অনুধাবন করতে হবে। বেসরকারি খাতে কোনো কাজ কোনো কর্মী আটকে রাখলে তাঁকে নিয়োগদাতার বরখাস্ত করার অধিকার থাকে। এ কারণে বেসরকারি খাতে কাজ দ্রুত হয়।

আমি নিজেও কিছু জায়গায় হয়রানির শিকার হচ্ছি। আমাদের একটি লোগোর অনুমোদন দুই বছরের মতো হলো আটকে আছে। চাইলে এ নিয়ে আমি সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে যেতে পারি। কিন্তু বিষয়টা হলো, আমরা নাহয় শীর্ষপর্যায়ে গিয়ে কাজ করিয়ে আনলাম, কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কী হবে? এটা তো কোনো ভালো ব্যবস্থা হলো না। দেশে যে নতুন উদ্যোক্তা সেভাবে গড়ে উঠছে না, তার একটা কারণ এটা।
ধরেন, একজন করদাতাকে সেরা করদাতার স্বীকৃতি দেওয়া হলো। তারপর তাঁকে আবার কর নিয়ে হয়রানি করা হলো। এটা মূল্যহীন। এতে ওই স্বীকৃতির কোনো অর্থ থাকে না। কারণ, ঘুম থেকে উঠে তাঁকে সেরা করদাতার স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কর দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দীর্ঘদিনের রেকর্ড দেখেই সেরার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে বিদেশি বিনিয়োগ আমরা উল্লেখযোগ্য হারে পাচ্ছি না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন কোনো দেশে যায়, তখন সেই দেশ সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নেয়। এ ক্ষেত্রে ডুয়িং বিজনেসে অবস্থানটাকে তারা খুব গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা বলছে, তা কিন্তু আজীবন থাকবে না। তাই আমাদের ডুয়িং বিজনেসে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে হবে।
আমার প্রস্তাব হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য একটি কমিটি করা এবং সেখানে বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করা দরকার। আমাদের এক দিনের জন্য ডাকা হলো, আমরা মতামত দিলাম, বিষয়টা সে রকম নয়। বেসরকারি খাতকে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে সংযুক্ত করতে হবে। আমরাই বলব, এটা সমস্যা, ওটা সমস্যা। কমিটি করে যদি প্রধানমন্ত্রীকে শুধু ভালো সংবাদ দেওয়া হয়, আর প্রতিবেদনে আসে নেতিবাচক অবস্থা, তাহলে কমিটির প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।

আমার আরেকটি প্রস্তাব হলো, সরকারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মন্ত্রণালয় করা উচিত। এ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী রাজনৈতিক হবেন, কিন্তু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিভাগে প্রতিমন্ত্রী থাকবেন, যাঁরা হবেন বেসরকারি খাতের।
পরবর্তী ডুয়িং বিজনেস সূচকের জন্য তথ্য নেওয়া হবে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত। এ সময়ে এমন কিছু কাজ বেছে নেওয়া দরকার, যা করলে বেশ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। ভারতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণের ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি করেছে। তারা এগিয়েছে। আমাদেরও এমন কিছু সহজ কাজ শেষ করতে হবে। এক দরজায় সব সেবা চালুর পর পাঁচ ধাপ উন্নতিতে আমি খুশি হব না।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যানকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া দরকার, যাতে প্রশাসনে তাঁর কথা সবাই শুনতে বাধ্য হন।

সাক্ষাৎকারের অনুলিখন: রাজীব আহমেদ।