সেচপাম্প রপ্তানিতে সম্ভাবনার হাতছানি

>
  • বছরে প্রায় ৫০ হাজার সেচপাম্প ছাড়াও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ভারতে রপ্তানি
  • সেচপাম্প রপ্তানি আয়ের পরিমাণ বছরে ৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা
  • সেচপাম্প ছাড়াও যন্ত্রাংশ ও লাইনার রপ্তানি করে বিপুল আয় হচ্ছে
  • ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি (বগুড়া–ভারত) আয় ২ লাখ ১০ হাজার ডলার
  • দেশীয় মুদ্রায় এ রপ্তানি আয়ের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা
  • চলতি অর্থবছরে বগুড়া থেকে এ খাতের রপ্তানি আয় গতবারের চেয়ে বাড়বে

বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানায় দেশীয় কারিগরদের তৈরি সেচপাম্প রপ্তানি হচ্ছে ভারতে। কৃষিতে সেচকাজে ব্যবহৃত এসব সেচপাম্প ভারতের কলকাতা ছাড়াও বিভিন্ন শহরের বাজার দখল করেছে।

এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বছরে প্রায় ৫০ হাজার সেচপাম্প ছাড়াও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রাংশ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিটি পাম্পের রপ্তানিমূল্য গড়ে ১৮ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৪ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় সেচপাম্প রপ্তানি আয়ের পরিমাণ বছরে ৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

সেচপাম্প ছাড়াও এর যন্ত্রাংশ এবং লাইনার রপ্তানি করে আরও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। শিগগিরই বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানায় তৈরি আন্তর্জাতিক মানের টিউবওয়েল রপ্তানি শুরু হবে বলেও আশাবাদী স্থানীয় উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকেরা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক কাজী মো. সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বগুড়া থেকে ভারতে সেচপাম্প ও এর যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে ২ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। দেশীয় মুদ্রায় এ রপ্তানি আয়ের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছরেও বগুড়া থেকে এ খাতের পণ্য রপ্তানি আয় গতবারের চেয়ে বাড়বে।

বগুড়া শিল্প ও বণিক সমিতির সহসভাপতি মাফুজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালে বগুড়া থেকে সেচপাম্পসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। এ সময় সমিতি থেকে ৮২৪টি সার্টিফিকেট অব অরজিন (উদ্যোক্তা সনদ) ইস্যু করা হয়েছে। সেচপাম্প রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, মেসার্স রণী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, মেসার্স মাইশা এন্টারপ্রাইজ এবং আজাদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস।

উদ্যোক্তারা জানান, বগুড়ায় বর্তমানে ছোট-বড় প্রায় এক হাজার শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। জেলার বিসিক শিল্পনগরী ছাড়াও শহর ও শহরতলির  সূত্রাপুর, ফুলবাড়ী, গোহাইল সড়ক, রেলওয়ে মার্কেট, শাপলা মার্কেট, বিআরটিসি শপিং কমপ্লেক্স, ঠনঠনিয়া, চারমাথা, ভবেরবাজার, চেলোপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব কারখানা গড়ে উঠেছে।

সেচপাম্প তৈরির পর তাতে রং করছেন একজন শ্রমিক। এসব সেচপাম্প দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। সম্প্রতি বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীর একটি কারখানায়।  ছবি: সোয়েল রানা
সেচপাম্প তৈরির পর তাতে রং করছেন একজন শ্রমিক। এসব সেচপাম্প দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। সম্প্রতি বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীর একটি কারখানায়। ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়ায় স্থাপিত কারখানাগুলোর মধ্যে ৫০০টি কৃষি যন্ত্রাংশ, ৪৫০টি হালকা প্রকৌশল এবং ৪২টি ফাউন্ড্রি শিল্প রয়েছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এসব কারখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় দেড় লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা।

দেশের অভ্যন্তরে কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হচ্ছে বগুড়ার এসব শিল্পকারখানা থেকে। কারখানাগুলো ঘিরে শহরের গোহাইল সড়ক ও স্টেশন সড়কে গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রাংশ ব্যবসার এক বড় বাজার।

যেভাবে তৈরি হয়

কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাটির নিচ থেকে পানি তোলার সেচপাম্প তৈরির অন্যতম কাঁচামাল পুরোনো ভাঙারি লোহা, জাহাজভাঙার লোহা, পিগ আয়রন, সিলিকন,হার্ড কোক ও ফার্নেস ওয়েল। ঢালাই কারখানাগুলোতে পুরোনো লোহা ফার্নেসের মধ্যে ঢেলে দিয়ে ২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় গলানোর পর লোহা ও ফাউন্ড্রির সমন্বয়ে তৈরি হয় পানির পাম্প। পুরোনো লোহা বাদে অন্যান্য কাঁচামাল আসে ভারত, চীন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে।

এ খাতের উদ্যোক্তা রণী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের ব্যবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, সেচপাম্প রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে ফাউন্ড্রি শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও এ শিল্পের প্রতি সরকারের খুব বেশি সুনজর নেই। পণ্যের মান ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে বাংলাদেশের এই কৃষিপণ্যের ভারতে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতে এ পণ্যের ওপর জেনারেল সেলস ট্যাক্স (জিএসটি) আরোপ হওয়ায় তাতে আমদানি খরচ বেড়ে যায়। তাই ভারতের আমদানিকারকেরা আরও কম দামে বাংলাদেশ থেকে পাম্প কিনতে চান। এখন বাংলাদেশে এ পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে হলে তাতে সরকারের সুনজর দরকার।

এ খাতের একাধিক উদ্যোক্তা বলেন, বাংলাদেশ থেকে সেচপাম্প রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোক্তাদের ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু সেই প্রণোদনার অর্থ ছাড় হতে ৬ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তাই উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রণোদনার অর্থ দ্রুততম সময়ে ছাড় করা হলে এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিলে তাতে রপ্তানি বহু গুণ বাড়বে।

ফোরাম অব এগ্রো মেশিনারিজ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রসেসিং জোনের সভাপতি গোলাম আজম বলেন, ‘বগুড়ায় উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশলশিল্প দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজার দখল করলেও এই শিল্পকে যুগোপযোগী এবং আধুনিকায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইলেও জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। বগুড়ার বিসিক শিল্পনগরীতে কোনো প্লট খালি নেই। আইনি জটিলতায় ঝুলে আছে এ এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পও। শিল্প স্থাপনের জন্য জমির সংস্থান করা গেলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।