ওদের কিছু নেই

দিনের পর দিন লোকসান গুনতে থাকা কর্ণফুলী পেপার মিলের (কেপিএম) অবস্থা এখন এমনই জরাজীর্ণ। এখানে বড় বড় যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালু নেই। মণ্ড তৈরির কারখানা আছে, চালু নেই। রক্ষণাবেক্ষণ নেই, কাঁচামাল নেই, দক্ষ শ্রমিক নেই।  ছবি: সৌরভ দাশ
দিনের পর দিন লোকসান গুনতে থাকা কর্ণফুলী পেপার মিলের (কেপিএম) অবস্থা এখন এমনই জরাজীর্ণ। এখানে বড় বড় যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালু নেই। মণ্ড তৈরির কারখানা আছে, চালু নেই। রক্ষণাবেক্ষণ নেই, কাঁচামাল নেই, দক্ষ শ্রমিক নেই। ছবি: সৌরভ দাশ
>
  • বড় বড় মেশিন আছে, চলার শক্তি নেই
  • মণ্ড তৈরির কারখানা আছে, চালু নেই
  • রক্ষণাবেক্ষণ নেই
  • উৎপাদন নেই

বয়সের ভারে ন্যুব্জ কর্ণফুলী পেপার মিলটির (কেপিএম) অবস্থা অনেকটা কবি অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের ‘ছন্নছাড়া’ কবিতার কয়েকটি লাইনের মতো। কবিতাটিতে কবি ছন্নছাড়া বেকার যুবকদের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে। ওদের কিছু নেই।’
কেপিএমের তেমনি বড় বড় মেশিন আছে। কিন্তু চলার শক্তি নেই। মণ্ড তৈরির কারখানা আছে, চালু নেই। রক্ষণাবেক্ষণ নেই, কাঁচামাল নেই, দক্ষ শ্রমিক নেই, ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় নেই, আয় নেই, রোজগার নেই, মূলধন নেই, সর্বোপরি উৎপাদন নেই।
দিনের পর দিন লোকসান গুনতে থাকা কেপিএমের পরিচালনা সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) দেওয়ার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। একই ব্যবস্থাপনায় নতুন একটি কাগজকল করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। সৌদি আরবের আল ফানা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই সমঝোতা স্মারক সই হয়।
রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা এলাকায় ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজকল কেপিএম প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন এ প্রতিষ্ঠানটি এখন রুগ্ণ থেকে রুগ্ণতর হচ্ছে। এরই মধ্যে শ্রমিক কমেছে ৮০ শতাংশ।
সিআইসির পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) শাহীন কামাল বলেন, কারখানাটি অনেক পুরোনো। লোকসান হচ্ছেই। তবে লোকসান অনেক কমেছে। এটির ব্যবস্থাপনার জন্য পিপিপির আওতায় সম্প্রতি সৌদি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমওইউ সই হয়েছে। সমঝোতার আওতায় নতুন কাগজকল করার পরিকল্পনা রয়েছে।

মরণদশা
প্রায় ৩০ বছর ধরে কেপিএমের কোনো সংস্কার (ওভারহোলিং) হয়নি। ফলে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুই বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মণ্ড তৈরির কারখানা বা প্লাপ সেকশন। মণ্ড তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১০ কোটি টাকার কাঁচামাল নষ্ট হওয়ার পথে। বর্তমানে আমদানি করা মণ্ডের ওপর নির্ভর করে সীমিত আকারে উৎপাদন করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। দিনে ৩০ টন পর্যন্ত কাগজ উৎপাদন হয় মাত্র।
গত ১ জুন রাঙামাটির তখনকার সাংসদ ঊষাতন তালুকদার শিল্পমন্ত্রী বরাবর কারখানাটির দৈন্যদশা তুলে ধরে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এম আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামাল–সংকট, দক্ষ জনবল–সংকট, তারল্য–সংকট রয়েছে মিলে। বর্তমানে বন্ধ রয়েছে ২ নম্বর মেশিনটি। এটি মেরামতের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ৩ নম্বর মেশিনটিও আংশিক চালু।

উৎপাদন কমছে, লোকসান বাড়ছে
প্রতিষ্ঠাকালীন এই কারখানার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার টন। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ১৮২ টন কাগজ। একই সময়ে লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা লোকসান দেয় কেপিএম। ওই বছর উৎপাদন ছিল ১০ হাজার ৫৮১ টন। সর্বশেষ ২০০৮-০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৬৩৮ কোটি টাকা লাভ করেছিল। তখন উৎপাদন ছিল ২৯ হাজার ৭৩ টন। বর্তমানে লোকসান কমে প্রায় ২০ কোটি টাকার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। একসময় কেপিএমে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছিলেন। এখন স্থায়ী–অস্থায়ী মিলে লোকবল ১ হাজারের মতো।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পার্বত্য চট্টগ্রাম–বিষয়ক সংসদীয় কমিটি গত অক্টোবরে কারখানাটি পরিদর্শন করে। তখন কমিটির কাছে এমডি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তাতে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে মিলের কিছু অংশের রক্ষণাবেক্ষণ এবং রিপ্লেসমেন্টের মাধ্যমে চার থেকে পাঁচ বছর উৎপাদন সচল রাখার প্রস্তাব করা হয়। সে জন্য ৫২ কোটি টাকা দরকার হবে বলে মিল কর্তৃপক্ষ সংসদীয় কমিটিকে জানায়।
এ ছাড়া মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে পিপিপির মাধ্যমে ১০০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইন্টিগ্রেটেড মণ্ড পেপার মিল স্থাপন করার কথা বলা হয়। তার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানানো হয়। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দিনে ৩০০ টন উৎপাদন সক্ষম আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন নতুন ইন্টিগ্রেটেড মণ্ড পেপার মিল স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই সৌদি প্রতিষ্ঠান আল ফানার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয়।
এদুই বছর ধরে যেসব শ্রমিক অবসরে কিংবা অন্যত্র বদলি হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের পাওনা পুরোপুরি বুঝে পাননি।

দেনায় জর্জরিত
বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা দেনায় রয়েছে কেপিএম। এর মধ্যে সরকারি ঋণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রয়েছে শ্রমিকের গ্র্যাচুইটি, বকেয়া মজুরি, ডিবেঞ্চার ঋণ, বিভিন্ন পণ্য এবং রাসায়নিক সরবরাহকারীদের দেনা অন্যতম। কেপিএমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির মোট দেনা ৭৪৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বিসিআইসির পরিচালক মোহাম্মদ শাহীন কামাল বলেন, দেনা আগের চেয়ে কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে নতুন মজুরি কমিশনের কারণে লোকসান আবার বাড়তে পারে। কারণ শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাবে।

সরেজমিন
সম্প্রতি কেপিএম ঘুরে দেখা যায়, কারখানার যন্ত্রপাতি সব জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে একটি ইউনিটে চলছে উৎপাদন কাজ। মণ্ড ইউনিটে দেখা যায় বাঁশের চিপস পড়ে রয়েছে। এই ইউনিটটির স্থানে স্থানে শেওলা জমে গেছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে নুরুল আলম নামের এক শ্রমিক বলেন, কারখানার যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ায় প্রতিদিন তা চালু করা যায় না। ফলে ২৪ ঘণ্টাও উৎপাদন চলে না।