বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও ভালো

>

*বৈশ্বিক পারিবারিক ব্যবসায় জরিপ ২০১৮ প্রতিবেদন প্রকাশ
*পিডব্লিউসি দুই বছর পরপর এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে
*পিডব্লিউসির জরিপে বাংলাদেশ এবারই প্রথম অন্তর্ভুক্ত
*পিডব্লিউসির জরিপে ৫৩ দেশের ব্যবসায়ীরা অংশ নেন
*বাংলাদেশে পারিবারিক ব্যবসায়ের চ্যালেঞ্জগুলো বেশি
*উদ্ভাবনী সক্ষমতায় বাংলাদেশে চ্যালেঞ্জ একটু কম

বিশ্বজুড়েই পারিবারিক ব্যবসায়ের চ্যালেঞ্জ বেশি, বাংলাদেশে তা আরও বেশি। দেশের পারিবারিক ব্যবসায় পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে দক্ষতার প্রশ্ন, উদ্ভাবন সক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা। তবে বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও ভালো। গত বছর প্রবৃদ্ধির বৈশ্বিক গড় ছিল যেখানে ৩৪ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের তা ছিল ৫৩ শতাংশ।

বিশ্বখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের (পিডব্লিউসি) ‘বৈশ্বিক পারিবারিক ব্যবসায় জরিপ ২০১৮’ প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে। পারিবারিক ব্যবসায়ের ওপর করা পিডব্লিউসির এ প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশিত হয়। পিডব্লিউসি দুই বছর পরপর এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও পারিবারিক ব্যবসায়ের ওপর বাংলাদেশে করেছে এবারই প্রথম।

জরিপে ৫৩টি দেশের ব্যবসায়ীরা অংশ নেন। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ব্যবসায়ের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ ডলারের বেশি রয়েছে এমন ২ হাজার ৯৫৩ জন ব্যবসায়ীর। সরাসরি সাক্ষাৎকার, টেলিফোন ও অনলাইনে গড়ে সবাই কথা বলেছেন ৩৫ মিনিট করে। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল থেকে ১০ আগস্টের মধ্যে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায়ের চ্যালেঞ্জগুলো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের চেয়েও বেশি। দক্ষতার প্রশ্নে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেখানে ৬০ শতাংশ, বাংলাদেশে তা ৬৬ শতাংশ। তবে উদ্ভাবনী সক্ষমতায় বৈশ্বিকের ৬৬ শতাংশের চেয়ে বাংলাদেশে চ্যালেঞ্জ একটু কম অর্থাৎ ৬৩ শতাংশ।

এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতায় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ৪৯ শতাংশের চেয়ে বাংলাদেশে ১৪ শতাংশ বেশি অর্থাৎ ৬৩ শতাংশ। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জ্বালানি ও কাঁচামালের দামে। এ ব্যাপারে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেখানে ৪৩ শতাংশ, বাংলাদেশে তা ৬৩ শতাংশ। আবার তথ্য ব্যবস্থাপনায় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেখানে ৩৯ শতাংশ, বাংলাদেশে তা ৫৩ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ব্যবসায়ের পেশাগত দিক, সাইবার নিরাপত্তা, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অর্থের সংস্থান, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, দুর্নীতি, উত্তরাধিকার ইত্যাদি। তবে হতাশার কথা রয়েছে যেমন, আশার বাণীও রয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের ৫০ শতাংশই মনে করেন, ভবিষ্যতে তাঁরা নতুন নতুন রপ্তানি বাজারের দিকে যাবেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে পারিবারিক ব্যবসায়ের পুঁজির উৎস বহুমাত্রিক হলেও ব্যাংকঋণই হচ্ছে প্রধানতম উৎস। শেয়ারবাজার, ভেনচার ক্যাপিটালও পুঁজির উৎস হিসেবে রয়েছে, তবে সেগুলো ব্যাংকের চেয়ে অনেক কম।

দেশের পারিবারিক ব্যবসায়ে ব্যাংকঋণ ৯৪ শতাংশ, এ ব্যাপারে বৈশ্বিক হার ৮১ শতাংশ। আবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করে ৬৩ শতাংশ, বৈশ্বিক গড় যেখানে ৭১ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ৭৫ শতাংশ পারিবারিক ব্যবসায়ে পরিবারের বাইরের দক্ষ লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ভারতেও একই প্রবণতা রয়েছে।

ব্যবসায়ের লক্ষ্য ও কৌশল
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা কম। বৈশ্বিক হার ৪৯ শতাংশের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র ৩৪ শতাংশ পারিবারিক ব্যবসায়ীর দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। আবার বাংলাদেশি পারিবারিক ব্যবসায়ীদের ৫০ শতাংশের পরিকল্পনা অনানুষ্ঠানিক, বৈশ্বিক এ হার যেখানে ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায়ীদের ১৬ শতাংশের কোনো দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই, বৈশ্বিকভাবে যা নেই ২১ শতাংশের।

ব্যবসায়ের নীতি পদ্ধতির দিক থেকেও বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে। বৈশ্বিক গড় ৮৪ শতাংশের পরিবর্তে বাংলাদেশে তা আছে ৭২ শতাংশের। তবে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে চুক্তি, পারিবারিক কাউন্সিল, বিরোধ নিষ্পত্তি ইত্যাদি বিষয়ে বৈশ্বিক মানের কাছাকাছিই আছে বাংলাদেশ।

কোনো কারণে ব্যবসায়ে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকারীর দরকার পড়ে। এ দিক থেকে বাংলাদেশের হার ৯ শতাংশ, যেখানে বৈশ্বিক হার ২৪ শতাংশ। ৬৩ শতাংশ ব্যবসায়ীর দাবি পারিবারিক ব্যবসায়ের বিরোধ নিষ্পত্তি তাঁরা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলেন। আর ৬ শতাংশ দাবি হচ্ছে, বিরোধ নিষ্পত্তিতে তাঁরা অন্যদের হস্তক্ষেপ নেন।

পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ব্যবসায়
জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ৯১ শতাংশ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর ইচ্ছা হচ্ছে ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্ব যাবে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। বৈশ্বিক এ হার ৫৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ইতিমধ্যে ব্যবসায়ে জড়িত হয়ে গেছেন। ব্যবসায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা রয়েছেন ৬৩ শতাংশ, বৈশ্বিক হার এ ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ।

তবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে পর্ষদে থাকার অংশ বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের হার মোটামুটি কাছাকাছি। বাংলাদেশে এ হার ৪১ শতাংশ, বৈশ্বিক ৩৭ শতাংশ। এদিকে বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায়ে পরবর্তী প্রজন্ম জড়িত রয়েছে কিন্তু শীর্ষ পদে নয়—এমন হার মাত্র ১৩ শতাংশ, বৈশ্বিক হার এ ক্ষেত্রে ৩১ শতাংশ।

ব্যবসায়ের উত্তরাধিকার
জরিপ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বজুড়েই উত্তরাধিকারের বিষয়টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভালোভাবেই প্রযোজ্য। পরবর্তী প্রজন্মই ব্যবসায়ের উত্তরাধিকার হবে—বৈশ্বিক হার এ ব্যাপারে ৩৭ শতাংশ, আর বাংলাদেশে এ হার ৯১ শতাংশ।

প্রতিবেদনে উঠে আসে জরিপে অংশ নেওয়া ১০০ জন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর মধ্যে ৬০ জন দ্বিতীয় প্রজন্ম, ৩২ জন তৃতীয় প্রজন্ম এবং ১৬ জন চতুর্থ প্রজন্মের। বাকি ২ জনের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায়ের পর্ষদে ২৫ শতাংশ নারী রয়েছেন। অথচ বিশ্বে এ হার আরও কম, ২১ শতাংশ। তবে দেশে মাত্র ১৪ শতাংশ নারী রয়েছেন পারিবারিক ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনায়, যে হার বিশ্বে ২৪ শতাংশ।