বিশ্বায়নের সুদিন শেষ?

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।
>তিন দশক ধরে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা বিশ্বায়নের চাকায় এখন যেন অনেকটাই ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। বিশ্বায়িত বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন সূচকে একটা মন্দার আভাস বেশ প্রকট হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের সুদিন কি তবে শেষ হয়ে এল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এই লেখায়। আজ প্রকাশিত হলো এর প্রথম পর্ব।

পণ্য, ধারণা ও অর্থের কোনো সীমানা থাকবে না—এটাই বিশ্বায়নের মূল কথা। এই মূল ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই তিন দশক ধরে বিশ্বের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। দেশের সঙ্গে দেশের, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের আন্তসংযোগের মূল ভিতটি গড়ে উঠেছে এই বিনিময়কে অবারিত করার মধ্য দিয়েই। ছোট-বড় সব দেশের মধ্যকার আন্তসম্পর্ক কী হবে, তা নির্ধারণে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করছে। এমনকি একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও আর এখন অভ্যন্তরীণ নয়। বিশ্বায়নের নানা সমীকরণ এই রাজনীতির নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে।

তিন দশক ধরে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা বিশ্বায়নের চাকায় এখন যেন অনেকটাই ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। এই ভুবনগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন সূচকে একটা মন্দার আভাস বেশ প্রকট হয়ে উঠছে। এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিশ্বায়নের বর্তমান গতিপ্রকৃতিকে ‘স্লোবালাইজেশন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’। ‘স্লোবালাইজেশন’ শব্দটি অবশ্য ২০১৫ সালে ডাচ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাডজেডস বাকাস প্রথম প্রয়োগ করেন বিশ্বায়নের গতি ও এর ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। কথা হচ্ছে, ঠিক কী এমন ঘটল যে ১৯৯০-এর পর একমাত্র বিশ্বতত্ত্ব হিসেবে নিজের আসন পোক্ত করা ‘গ্লোবালাইজেশনে’র গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যায় এমন একটি শব্দ প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াল?

বিশ্বায়নের ধীরগতির বিষয়টি নতুন নয়। গত দশকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে দেখা দেওয়া মন্দা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিশ্বায়নের চাকার শক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এবং এই প্রশ্নকে যৌক্তিক প্রমাণ করেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকে অবনমন দেখা দিতে শুরু করে। কিন্তু এই সময়ে এসে বিষয়টি এভাবে আলোচনায় আসার মূল কারণ ওই যুক্তরাষ্ট্রই। আরও ভালোভাবে বললে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুরু হওয়া শুল্কযুদ্ধ তথা বাণিজ্যযুদ্ধের কথা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই বর্তমান বিশ্বায়িত কাঠামোটি গড়ে ওঠে, যা ১৯৯০ সালের পর তার একচ্ছত্র অধিকারে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে দ্বিমেরু বিশ্বকাঠামো ভেঙে এক মেরু কাঠামো যেদিন থেকে তার বিজয় ঘোষণা করল, সেদিন থেকে বিশ্বায়নের তত্ত্বই সবকিছুর নিয়ন্তা হয়ে উঠল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মতো বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এই কাঠামো থিতু হলো তার সমস্ত শক্তি নিয়ে। পুঁজির বিশ্বে অবারিত হলো পণ্য ও অর্থ। আর্থিক খাত মুক্ত হলো। আর এই আপাতমুক্ত পরিসরকে উদাহরণ হিসেবে সামনে টেনে পুঁজিকেন্দ্র বিশ্বকে অভিধা দিল ‘বিশ্বগ্রাম’ বলে। যদিও এই বিশ্বগ্রামে সাধারণ মানুষ মুক্ত হলো না, পণ্য না হয়ে ওঠা পর্যন্ত। অভিবাসন, শরণার্থী সংকটসহ দেশে দেশে বিদ্যমান মানবিক বিভিন্ন সংকট এরই প্রমাণ বহন করে।

আপাত হোক আর প্রকৃতই হোক, বিশ্বায়ন একটি মুক্ত বিশ্বের কথা বলেছে। পুঁজির স্বার্থেই সে পণ্য ও বিনিয়োগকে মুক্ত করেছে। কিন্তু এখন এই ‘মুক্ত’ অভিধাটিও হারাতে বসেছে বিশ্বায়নের বিশ্ব। যে রক্ষণশীলতাকে এত দিন সমালোচনা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, সেই রক্ষণশীলতাকেই সে এখন তার লক্ষ্য করেছে। অন্তত চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক দ্বৈরথে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রক্ষণশীলই। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই দিকবদলের ইঙ্গিত আগেই পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিলেন, তা রক্ষণশীলই ছিল। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এই দিকবদল আর যা-ই হোক হঠাৎ করে হয়েছে, তা বলা যাবে না।

ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, বিশ্বায়নের ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য ১৯৯০ সালের জিডিপির ৩৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৮ সালের ৫৮ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে দায় ও সম্পদের পরিমাণও। বেড়েছে অভিবাসনের হারও। ১৯৯০ সালে অভিবাসনের হার যেখানে ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ, আজকে তা বেড়ে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু যখন ইকোনমিস্ট জানায়, বৈশ্বিক জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান ২০০৮ সালেও ছিল ৬১ শতাংশ, তখন বিশ্বায়নের বর্তমান গতির দিকে তাকাতেই হয়। সাময়িকীটির দেওয়া তথ্যমতে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে মধ্যম পর্যায়ের পণ্যের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত এ ধরনের পণ্যের আমদানি-রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও ২০০৮ সালের পর এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অবনমন হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অগ্রযাত্রা থমকে গেছে। বৈশ্বিক মুনাফায় ২০০৮ সালে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের অংশ ৩৩ শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ ২০০৭ সালে ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে এ হার ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আন্তর্দেশীয় ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ২০০৬ সালের জিডিপির ৬০ শতাংশ থেকে নেমে বর্তমানে প্রায় ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিপ্রবাহ ২০০৭ সালের ৭ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে দেড় শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসের তথ্যমতে, এত সব অবনমনের ভিড়ে গত এক দশকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন কিছুটা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক পার্সেল ও ফ্লাইটের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আর তথ্যপ্রবাহ এক দশক আগের চেয়ে বেড়েছে ৬৪ গুণ। কিন্তু এগুলো বিশ্বায়নের ধীরগতিতে কোনো ত্বরকের ভূমিকা নিতে পারছে না।

২০১৫ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক গবেষণায় বিশ্বায়নের চাকায় এই উল্টো টানের কারণ হিসেবে বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিসর আঞ্চলিক পরিসরে আটকে যাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘দ্য গ্লোবাল ট্রেড স্লোডাউন: সাইক্লিক্যাল অর স্ট্রাকচারাল?’ শীর্ষক ওই গবেষণার উপসংহারে গবেষক ক্রিস্টিনা কন্সটানটিনেস্কু ও আদিত্য মাতু বলেছেন, ‘বৈশ্বিকভাবেই বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ নেটওয়ার্ক সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক বাণিজ্যে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।’ ওই গবেষণায় এই ধীরগতির কারণ হিসেবে চীনের বাণিজ্য নীতিকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

কিন্তু, শুধু কি চীনের ‘মহাপ্রাচীরেই’ আটকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি রকেট গতির বিশ্বায়ন? নাকি এর পেছনে মার্কিন কারণও আছে?

পড়ুন আগামীকাল দ্বিতীয় পর্বে: বিশ্বায়নের দুর্দিনে দায়ী কে?