পরিবেশবান্ধব নির্মাণে নিরাপদ বসবাস

পরিবেশবান্ধব একটি ভবন।  সংগৃহীত
পরিবেশবান্ধব একটি ভবন। সংগৃহীত

পরিবেশবান্ধব কথাটি এখন সবার মুখে মুখে। কিন্তু কথাটি সবাই বুঝতে পারছি কি না এবং এটির গুরুত্ব কতটা অনুধাবন করছি, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। নির্মাণও এমনই একটি ব্যাপার। মূলত পরিবেশবান্ধব নির্মাণ বলতে সম্পদের সঠিক ব্যবহারে নিরাপদ স্থাপনাকেই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে স্থপতি, প্রকৌশলী, গ্রাহক ও নির্মাতা সবারই ভূমিকা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের যে লড়াই চলছে, তাতে কেবল দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য চর্চা নয়, বরং পরিবেশবান্ধব, মানববান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য চর্চা ও নির্মাণ অত্যন্ত প্রয়োজন।

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ আমাদের কেন দরকার? কেননা আমরা প্রকৃতি আর পরিবেশ থেকেই সবকিছু গ্রহণ করে এই সভ্যতা তৈরি করেছি। সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই আমাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস ঠিক রাখতে হবে, যেন পৃথিবী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য থাকে। কিন্তু নির্মাণ ও উন্নয়নকে চলমান রাখতে গিয়ে আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে না আনি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দরকার সবুজ। কিন্তু অকাতরে হারিয়ে যাচ্ছে এই সবুজ আমাদেরই কারণে। বিশুদ্ধ বায়ু, নির্মল পরিবেশ, নিরাপদ পানি আমাদের বেঁচে থাকার শর্ত হলেও আমরা কিন্তু ক্রমেই নষ্ট করে যাচ্ছি এই অমূল্য সম্পদগুলো।
তাহলে আমরা বর্তমানে যা নির্মাণ করছি তা কি পরিবেশবান্ধব নয়? উত্তর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নয়। কেন? অনেক উদাহরণই দেওয়া যাবে। ইটের কথাই ধরা যাক। দেশে এখন কমবেশি ৩ হাজার কোটি পোড়ামাটির ইট ব্যবহৃত হচ্ছে আর এর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৭ কোটি টন কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি। এতে নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি, ব্যাহত হচ্ছে বিপুল জনসংখ্যার এই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ১ শতাংশ কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এর ৯৭ ভাগ নষ্ট হচ্ছে অপরিকল্পিত গ্রামীণ গৃহায়ণ ও ইটের ভাটার কারণে। অন্যদিকে, ইট তৈরির কারণে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৫০ লাখ টন কয়লা ও ৩০ লাখ টন জ্বালানি কাঠ। ফলে বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টন কার্বন ডাই–অক্সাইড, যা দেশের মোট নির্গত কার্বন ডাই–অক্সাইডের শতকরা ৩০ ভাগ। নগরায়ণ আর কংক্রিটে বাঁধানো নির্মাণ আরামদায়ক আর দৃষ্টিনন্দন হলেও বন্ধ করে দিচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে পানির রিজার্ভ এবং সৃষ্টি করছে শহরে জলাবদ্ধতার। নির্মাণসামগ্রী তৈরি আর ব্যবহার দুটোই নিচ্ছে প্রচুর পরিমাণে শক্তি। আজকের এই উন্নয়ন পরিক্রমায়ে কংক্রিট আমাদের একটি অপরিহার্য উপাদান। দেশে প্রতিবছর সাত হাজার ঘনমিটার কংক্রিট ব্যবহার করা হয় আর এই ব্যবহার প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বিশ্বে ৫ শতাংশ তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এই কংক্রিটের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৫-২০ বছর আগে কাঠের দরজা ব্যবহার হতো, এরপর এল হার্ডবোর্ড আর এখন ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ কী, ভেবে দেখছি কি?

তাহলে পরিবেশবান্ধব নির্মাণের জন্য কী করতে হবে। তেমন বাড়তি কিছু করার দরকার নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সচেতনতা আর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কাজগুলো পরিহার। যেমন জৈব কংক্রিট, ঝাঁজর বা ছিদ্র যুক্ত ইট বা কংক্রিট তৈরি ও ব্যবহার। প্রকৌশলীদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। যে কাজটা তাঁদের করতে হবে তা হলো নির্মাণসামগ্রী উৎপাদনের সময় দূষণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। নির্মাণের সময়, এরপর ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে শূন্য দূষণ এবং যখন নির্মাণ ধ্বংস করে ফেলা হবে, তখনো যেন শূন্য দূষণ হয়।

পরিবেশবান্ধব নির্মাণের জন্য প্রথমত নির্মাণকালে পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে, এ সময় পরিবেশ যাতে দূষিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। যেমন যেসব উপাদান সহজে মাটিতে মিশে যেতে পারে না, তার ব্যবহার বন্ধ বা কমাতে হবে। আগে বলে এসেছি প্লাস্টিকের দরজার কথা। একটি স্থাপত্যের শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য বা ব্যবহারিক সুবিধাই বড় কথা নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদে কিংবা এর জীবনচক্রের যেকোনো একটি সময়ে এটি কোনোভাবেই যেন পরিবেশের ক্ষতি করতে না পারে, এটি মাথায় রাখতে হবে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই ধরনের নির্মাণের ফলে আমরা কী কী সুবিধা পাব। পরিবেশবান্ধব নির্মাণের সুবিধা বহুবিধ। এ ধরনের নির্মাণে আমাদের সীমিত সম্পদের সঠিক ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। যেহেতু এ প্রক্রিয়ায় সীমিত সম্পদের সঠিক ও দক্ষ ব্যবহার হয়, ফলে নির্মাণ ও ব্যবহারকালীন নিট খরচ কমে আসে। যেমন দিনের বেলা প্রাকৃতিক আলো দিয়ে সহজেই চাহিদা পূরণ করতে পারি। কিন্তু আমাদের অসচেতনতায়, কিংবা ডিজাইন ত্রুটির কারণে অথবা কিছু নিয়মনীতি না মেনে চলায় যদি বাতি জ্বালিয়ে সে আলোর ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে আমরা প্রকৃতির সহজলভ্য সুবিধা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হব। এতে বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যাবে। ভবনে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে ওয়াসার ওপর নির্ভরতা কমবে। পানির খরচও সাশ্রয় হবে। নির্মাণের শুরুতেই যদি এমনভাবে জায়গা নির্বাচন করতে পারি, যেন উত্তর–দক্ষিণের বায়ু চলাচল সুবিধা নেওয়া যায়, তবে এমনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের প্রয়োজন এড়ানো যেতে পারে। ভিয়েতনামে সম্প্রতি কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রাকৃতিক সম্পদের সুন্দর ব্যবহারের ফলে এ ধরনের স্থাপনায় বসবাসকারীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা খরচ ও ঝুঁকি কমে। তদুপরি এ ধরনের স্থাপনার পুনঃ বিক্রির ক্ষেত্রে ভালো দামও পাওয়া যায়।

স্থপতি, প্রকৌশলী ও নির্মাতা সবাই এখন পরিবেশবান্ধব নির্মাণে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। সামান্য একটু আইডিয়ার পরিবর্তন অথবা বাহ্যিক সৌন্দর্যে একটু ছাড় দিয়ে হলেও স্থপতি ও প্রকৌশলীরা পরিবেশবান্ধব হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। সহজলভ্য প্রাকৃতিক উপায়, উপকরণ ও সুবিধাগুলো বেশি বেশি ব্যবহার এবং কৃত্রিম উপায় উপকরণের ওপর নির্ভরতা কমানোই আমাদের লক্ষ্য।
এ ক্ষেত্রে নির্মাণবিধি পরিমার্জন এবং সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণবিধি অমান্য করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নির্মাণের জন্য যেন জলাশয় ভরাট না হয়, কৃষিজমি নষ্ট না হয় এবং পরিবেশের ক্ষতি এড়ানো যায়, সেটা সবাইকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। নির্মাণের সময় যেন কোনো দূষণ না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে পরিবেশবান্ধব নির্মাণসহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই সহজ।

লেখক: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।