২০৩০ সাল পর্যন্ত ইস্পাত খাতে প্রবৃদ্ধি হবে

মোহাম্মদ আলমাস শিমুল
মোহাম্মদ আলমাস শিমুল
ইস্পাত খাতে দেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে জিপিএইচ গ্রুপ। ইস্পাত খাতের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাসুদ মিলাদ

প্রথম আলো: লৌহ ও ইস্পাত খাতের বাজারের অবস্থা এখন কেমন?

আলমাস শিমুল: ইস্পাত খাতে বছরে গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এর কারণ হলো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। ১০ বছর ধরে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির হার গড়ে বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। গত বছর জিডিপির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। জিডিপির সঙ্গে নির্মাণ খাতের সম্পর্ক রয়েছে। জিডিপি বাড়লে নির্মাণসামগ্রীর বাজারও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
সরকারি খাতে কয়েক বছর ধরে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। আবার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। প্রবাসী আয় বাড়ায় এখন গ্রামেও পাকা ঘর নির্মাণ হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইস্পাত খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত ইস্পাত খাতে এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
প্রথম আলো: জিপিএইচ বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইস্পাত পণ্য উৎপাদনে যাচ্ছে। এতে বিনিয়োগ করতে হয়েছে বেশি। বিনিয়োগে এমন সাহসী উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে কী কারণ?
আলমাস শিমুল: জিপিএইচ ইস্পাত দেশের ‘কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস’ নিয়ে এসেছে। এর সঙ্গে আছে ‘উইনলিংক ফ্লেক্স’ প্রযুক্তি। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মূল কারণ একটি। মানুষ এখন অনেক সচেতন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে। সচেতন মানুষ এখন সর্বোচ্চ মানের পণ্যই কিনতে চায়। ইস্পাত পণ্যে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে হলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। এ জন্যই বিনিয়োগ বেশি হলেও জিপিএইচ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে এসেছে।
প্রথম আলো: ইস্পাত খাতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকট ছিল একসময় বড় চ্যালেঞ্জ। এ খাতে এখন নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
আলমাস শিমুল: শুধু ইস্পাত নয়, টানা কয়েক বছর চট্টগ্রামে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে শিল্প উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছিলেন। গ্যাসভিত্তিক নতুন কারখানা করা যায়নি। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে বিদ্যমান কারখানাগুলোতে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে এখন বিদ্যুৎ সমস্যা কেটে গেছে। গ্যাস সমস্যাও কেটে যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা কেটে যাওয়ার পর নতুন সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পানি–সংকট। বিশেষ করে সীতাকুণ্ডে যেসব শিল্পকারখানা আছে, সব কটি পানি–সংকটের কারণে ভুগছে। ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরে গিয়েও পানি মিলছে না। পানি ছাড়া কাচ, ইস্পাতসহ বেশির ভাগ শিল্পকারখানা চালানো যায় না।
প্রথম আলো: পানি–সংকট কাটানোর সহজ সমাধান কোনটি?
আলমাস শিমুল: সীতাকুণ্ড অঞ্চল পাহাড়বেষ্টিত। এখানে পাহাড়ি ছড়া আছে। বৃষ্টির সময় এই পানি ছড়া ও ছোট নালায় গড়িয়ে সাগরে চলে যায়। পাহাড়ে ছোটখাটো বাঁধ দিয়ে এই পানি সংরক্ষণ করার সুযোগ আছে। তাহলে শিল্পকারখানার পানি–সংকটের সহজ সমাধান হবে। পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণের জন্য সরকারের নীতি সহায়তা দরকার।
প্রথম আলো: চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা প্রায়ই বলেন, দেশের অন্য স্থানের তুলনায় তারা উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে তুলনামূলক কম সুবিধা পাচ্ছেন। এ নিয়ে বলুন।
আলমাস শিমুল: চট্টগ্রামের উৎপাদিত শিল্পপণ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন করা হয়। এই মহাসড়কে মিরসরাইয়ে স্থায়ী ভ্যাট তল্লাশিকেন্দ্র রয়েছে। ফলে চট্টগ্রামের শিল্পে উৎপাদিত পণ্যে সব ধরনের মাশুল পরিশোধ করতে হয়। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে দেশের অন্যান্য শিল্পাঞ্চল–সংলগ্ন মহাসড়কে ভ্যাট তল্লাশিকেন্দ্র নেই। ফলে সেসব শিল্পাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্যে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকে। ভ্যাট ফাঁকি দিলে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও আয়কর ফাঁকি দেওয়া সহজ হয়। ফলে অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে চট্টগ্রামের শিল্পপণ্যের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়ছে। গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় ভ্যাট তল্লাশিকেন্দ্র স্থাপন করা হলে সরকারের রাজস্ব আয় যেমন বাড়বে, তেমনি পণ্য উৎপাদন খরচেও সব জায়গায় সমতা আসবে। আবার মহাসড়কে ওজনসীমা নিয়ন্ত্রণের যে বিধান আছে, তা শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। অন্যান্য মহাসড়কেও তা কড়াকড়ি করতে হবে।
প্রথম আলো: ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানিতে এখন বন্দর সুবিধার কতটুকু উন্নতি হয়েছে?
আলমাস শিমুল: ইস্পাত পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে বন্দর সুবিধা যথেষ্ট বেড়েছে। তবে সামনে কাঁচামাল আমদানি ব্যাপক হারে বাড়বে। সে জন্য বন্দর সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। বে–টার্মিনালের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। আবার নদীতীরে বেসরকারি জেটি স্থাপনে সরকারি নীতি সহজ করতে হবে।
আবার শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানের নৌবন্দরগুলোকেও আধুনিকায়ন করা দরকার। সড়কের ওপর চাপ কমাতে এই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। যেমন নৌপথে তিন হাজার টন পণ্য নিতে একটি ছোট আকারের লাইটার জাহাজ দরকার। এই পণ্য সড়কপথে নিতে হলে ছয় চাকার ২৩০টি ট্রাক দরকার হবে। এই সুবিধা দ্রুত পেতে নৌবন্দরগুলো উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাহলে চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, বরিশাল, ভোলার মতো এলাকায় খুব সহজেই নৌপথে ভারী পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে।